রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে সংঘর্ষ
2020.10.07
ঢাকা ও কক্সবাজার
আপডেট: ৮ অক্টোবর ২০২০। ইস্টার্ন সময় দুপুর ১২:৩০
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসীদের দুটি পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ৮ জন নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে মঙ্গলবার নিহত হয়েছেন দুই শরণার্থী এবং দুই বাংলাদেশি। সোমবার সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন আরও তিনজন এবং শুক্রবার একজন। ।
এই ঘটনায় জড়িত নয় রোহিঙ্গাকে মঙ্গলবার টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চাকমারকুলের পাহাড়ি এলাকা থেকে চারটি দেশে তৈরি অস্ত্র, ২০ রাউন্ড কার্তুজ, ধারালো কিরিচ, লোহার রড ও গুলতিসহ আটক করেছে র্যাব।
তারা সবাই কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা এবং সেখানে ‘গোলাগুলি’র ঘটনায় তারা জড়িত ছিল জানিয়ে র্যাব-১৫ উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার মুখে তারা এলাকা থেকে ছেড়ে চাকমারকুলের পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছিল।
এর আগে শুক্রবার উখিয়ার পালংখালীতে অস্ত্রের কারখানা আবিস্কার করে র্যাব। সেখান থেকে আনোয়ার (৫০) ও এখলাস (৩২) নামের অস্ত্রের কারিগরকে আটক তিনটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলি ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে।
চট্টগ্রামের মহেশখালী থেকে আসা ওই দুই কারিগরের বরাত দিয়ে র্যাব-১৫ উপ-অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান বেনারকে বলেলেন, “প্রায় তিন বছর ধরে অস্ত্র বানিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে সরবরাহ করার কথা স্বীকার করেছে তারা।”
উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা, হ্নিলায় বিক্ষোভ
উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বেনারকে জানান, রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় প্রায় সাড়ে সাতলাখ বাসিন্দা উদ্বিগ্ন।
“রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। শিবিরগুলো সন্ত্রাসীদের আঁখড়ায় পরিণত হয়েছে। ইয়াবাসহ সব ধরণের চোরাচালান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এখন সেখান থেকেই,” বলেন তিনি।
“কুতুপালংয়ে বাংলাদেশি গাড়ি চালক ও সহকারির মৃত্যুর খবর পেয়ে বুধবার দুপুরে ভাড়ায় চালিত গাড়ির শ্রমিকরা টেকনাফের হ্নীলা বাস স্টেশন এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের শান্ত করেন,” বেনারকে বলেন হ্নীলার ইউপি সদস্য মো. আলী।
এছাড়া কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত শিবিরের নারী-শিশুদের একটি দল নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে দিনভর মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে।
কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া চৌরাস্তায় প্রতিবাদী অবস্থানে অংশ নেওয়া ছলিমা নামের এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, “আমরা সবাই র্নিভয়ে ঘরে থাকতে চাই। যেসব অপরাধী ক্যাম্পের পরিস্থিতি খারাপ করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। আমরা এসব থেকে পরিত্রাণ চাই।”
অন্যদিকে সরেজমিনে টেকনাফের লেদা, জাদিমুরা, শালবন, নয়াপাড়া ও নতুন লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে দেখা গেছে দেখা গেছে সেখানকার রোহিঙ্গা নেতারাও সর্তক রয়েছেন।
“উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্পে খুব মারামারি চলছে। সেখান থেকে কোনো সন্ত্রাসী যাতে পালিয়ে আমাদের ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য সবাইকে সর্তক থাকলে বলা হয়েছে,” বলেন তিনি।
কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া শিবির থেকে পরিবারসহ পালিয়ে এসে টেকনাফের একটি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গা নারী ছেনেয়ারা বেগম। বুধবার বেনারকে তিনি বলেন, “সেখানে অনেক বেশী মারামারি হচ্ছে। থাকার মতো কোনো অবস্থা নেই। আমার মতো অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।”
পরিস্থিতি শান্ত হলে লম্বাশিয়ার ফিরে যাওয়া কথাও জানান তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক যা বলছেন
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “রাখাইন বা মিয়ানমারে যাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং এই আধিপত্যের লড়াইয়ে মত্ত হয়েছে।”
“দেশের ভেতর থেকে তারা কোনো ইন্ধন বা মদদ পাচ্ছে না। এটা দেশের বাইরের শক্তি। বর্তমানে বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক শক্তি রোহিঙ্গাদের নিয়ে নিজেদের মতো করে খেলতে চাচ্ছে। এটাই মূল সমস্যা,” বলেন তিনি।
তাঁর দাবি, যেহেতু তাদের জনপ্রিয়তা নেই এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী যথেষ্টও সক্রিয় হয়েছে, সেহেতু তারা খুব বেশীদিন টিকতে পারবে না। বড়জোর সাময়িকভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরী করবে।
তবে রোহিঙ্গারা যতদিন থাকবে ততোদিন শরণার্থী শিবিরগুলোতে অভ্যন্তরীন সংঘাতের ঝূঁকিও থেকে যাবে উল্লেখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, “ওই অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে হলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা সবচেয়ে জরুরী।”
এক্ষেত্রে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তা একটি সামরিক সংঘাতেরও সূচনার করতে পারে বলে উল্লেখ করেন ইনস্টিটিউট অব কনফিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসের (আইসিএলডিএস) এই নির্বাহী পরিচালক।
কক্সবাজার থেকে প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।
সংশোধনী: মূল প্রতিবেদনে মঙ্গলবারে নিহত চারজনকে ভুলভাবে রোহিঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছি। তথ্য সংশোধন করা হলো।