ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্ত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2021.10.08
ঢাকা ও কক্সবাজার
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যুক্ত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ভাসানচরের যাবার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর জাহাজে উঠতে যাচ্ছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা। ৩০ জানুয়ারি ২০২১।
[এএফপি]

দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। এই লক্ষ্যে শনিবার সরকারের সাথে সংস্থাটি একটি সমঝোতা স্মারক করবে বলে শুক্রবার বেনারকে নিশ্চিত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হলে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর সমস্যা থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের মতামত জানতে ইউএনএইচসিআর এর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি লেখা হলেও শুক্রবার এই প্রতিবেদন লেখার সময় রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জবাব পাওয়া যায়নি।

তবে বার্তা সংস্থা এএফপির কাছে শনিবার এই চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে ইউএনএইচসিআর।

“অবশেষে তাঁরা (ইউএনএইচসিআর) ভাসানচরে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। শনিবার তারা আমাদের মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে,” শুক্রবার বেনারকে বলেন প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

তিনি বলেন, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর ইউএনএইচসিআর “কক্সবাজারে যেভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেভাবে ভাসানচরেও করবে।”

বর্তমানে ভাসানচরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সেখানকার রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এরপর থেকে ভাসানচরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের “খাদ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মানবিক সহায়তা প্রদান করবে ইউএনএইচসিআর।”

যেহেতু ইউএনএইচসিআর ভাসানচরে কাজ শুরু করছে, সেহেতু ভালো জীবনযাপনের জন্য আরও রোহিঙ্গা সেখানে যেতে রাজি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী।

“আমরা আগামীতে কয়েক দফায় ৮৩ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করব,” বলেন তিনি। 

জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করার পরই ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী। 

প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে কক্সবাজার সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে বন ও পাহাড় কেটে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় দেয়া হয় তাঁদের।

কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে ২০১৭ সালে নিজস্ব অর্থায়নে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে নির্মাণ করা হয় শরণার্থী শিবির। দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের মধ্যে হওয়ায় সেখানে স্থানান্তরের বিরোধিতা করে আসছিল ইউএনএইচসিআর। 

রোহিঙ্গারা লাভবান হবে

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতার পরও কিছু রোহিঙ্গা উন্নত জীবনের আশায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়। গত বছর ডিসেম্বর মাস থেকে কয়েক দফায় ১৯ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে স্বেচ্ছায় ভাসানচরে স্থানান্তর করে সরকার।

তবে সেখানকার রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভাসানচর থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। অনেকেই সাগরে ডুবে মারা গেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ভাসানচরে উন্নত খাবার দেয়া হয় না। সেখানকার স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাও কক্সবাজারের চেয়ে কম।

ইউএনএইচসিআর ভাসানচরে কাজ শুরু করায় “রোহিঙ্গারা লাভবান হবে,” বলে মন্তব্য করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান মুনশি ফায়েজ আহমাদ।

“রোহিঙ্গারা ইউএনএইচসিআর-কে বিশ্বাস করে। যেহেতু ইউএনএইচসিআর সেখানে যাচ্ছে, সেহেতু আরও রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে,” শুক্রবার বেনারকে বলেন তিনি। 

তিনি বলেন, “কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর চাইতে ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা উন্নতমানের। সেখানে তারা ভালোভাবে থাকতে পারবে। কক্সবাজার শিবিরের ওপর কিছুটা হলেও চাপ কমবে।”

“কক্সবাজার শিবিরকে কেন্দ্র করে হানাহানি, মারামারি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাসানচরে সেগুলো হবে না। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে পারবে,” যোগ করেন মুনশি ফায়েজ। 

খুশি রোহিঙ্গারা, তবে কাজের সুযোগ দাবি

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের মতো নোয়াখালীর সাগরদ্বীপ ভাসানচরেও জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা দেবে—এমন খবরে খুশি ভাসানচরের রোহিঙ্গারা। তবে এ সহযোগিতার পাশাপাশি দ্বীপে কাজের সুযোগ চান তাঁরা।

“জাতিসংঘ ভাসানচরে মানবিক সেবা কার্যক্রম চালু করবে, এজন্য আমরা খুব খুশি। কক্সবাজারের মতো এখানেও সামগ্রিকভাবে সুযোগ–সুবিধা বাড়বে। এতে করে ভাসানচর থেকে পালানোর প্রবণতা অনেকটা কমে আসবে,” শুক্রবার টেলিফোনে বেনারকে জানান সেখানকার এক রোহিঙ্গা নেতা মো. ইউনুচ। 

তিনি বলেন, “এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার থেকে ভাসানচর এসেছে। কিছু দিন আগে আমরা হিসাব করে দেখেছি এর মধ্যে এক হাজার ৯০০ জন পালিয়ে গেছে।”

কক্সবাজারে সবকটি রোহিঙ্গা শিবিরে কাজের সুযোগ থাকলেও ভাসানচরে তা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “পর্যাপ্ত খাবারের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগও দিতে হবে।” 

ভাসানচরের অন্য এক রোহিঙ্গা নেতা আব্দুল কাদের বেনারকে বলেন, “মাছ চাষ, চাষাবাদ, শাক-সবজির আবাদসহ নানা ধরনের কাজের সুযোগ–সুবিধার কথা শুনে আমরা ভাসানচরে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি খাবার পেলেও কোনো ধরনের ইনকামের সুযোগ নেই। জাতিসংঘ এবং সরকারকে এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।” 

তবে “কক্সবাজার থেকে নতুন করে ভাসানচরে যেতে রাজি হবে কিনা এটা নির্ভর করবে, যারা সেখানে বাস করছে তাদের থেকে কোনো অভিযোগ আসছে কিনা” তার ওপর বলে মনে করেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস-এর সেক্রেটারি মো. জুবায়ের।

“ওরা পজেটিভ ধারণা দিলে তবেই রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে রাজি হবে”, বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।