রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর প্রস্তত

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.10.12
ঢাকা
181012_Relocation_Rohingyas_1000.jpg ট্রলার থেকে নেমে হাঁটুপানি ভেঙে ভাসানচরের দিকে যাচ্ছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। ৪ অক্টোবর ২০১৮।
বেনারনিউজ

রোহিঙ্গাদের জন্য উন্নত সুবিধাসহ নোয়াখালীর ভাসানচরে নবনির্মিত আবাসন প্রকল্প শরণার্থী স্থানান্তরের জন্য প্রস্তত বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা।

“ভাসানচরের রোহিঙ্গা শিবির প্রস্তত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্টোবর মাসেই ওই শিবির আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন,” বেনারকে বলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের রোহিঙ্গা সেলের প্রধান হাবিবুল কবির চৌধুরী।

উদ্বোধনের পরই রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথম পর্যায়ে ২৫ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হবে।”

গত বৃহস্পতিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও সাংবাদিকদের বলেন, ভাসানচর রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য প্রস্তত।

তবে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়ার কোনো তারিখ এখনো ঠিক হয়নি বলে জানান হাবিবুল কবির চৌধুরী। এর আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবছর জুনে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও সেই লক্ষ্য ব্যর্থ হয়।

এদিকে ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী আবাসন প্রকল্প নেওয়া হলেও সেখানে পাঠানোর জন্য কীভাবে রোহিঙ্গাদের নির্বাচন করা হবে তা এখনো ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও পূনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

তিনি বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নেয়ার প্রক্রিয়া এখনো নির্ধারিত হয়নি। কোন পদ্ধতিতে আমরা ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে থেকে এক লাখ মানুষকে নির্বাচন করব সেব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”

“তবে, এটুকু বলতে পারি, যে কাউকে জোর করে ভাসানচরে পাঠানো হবে না,” বলেন আবুল কালাম।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকারের সাথে কাজ করছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। প্রত্যাবাসনে সহয়তা করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই সরকারের সাথেই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সংস্থাটি।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর বিষয়ে সময় ও পরিকল্পানা সম্পর্কে ইউএনএইচসিআর-কে সরকার অবহিত না করায় তাদের কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই বলে এক ই-মেইলে বেনারকে জানান সংস্থাটির মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা।

তবে তিনি জানান, কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শিবিরগুলো থেকে ভালো বিকল্প স্থানে শরণার্থীদের স্থানান্তরের বিষয়ে সরকারের সাথে জাতিসংঘ আলোচনা করছে।

‘না দেখে কীভাবে সেখানে যাই?’

উন্নত সুবিধা থাকলেও অনেক রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক।

উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মো. আফজাল টেলিফোনে বেনারকে জানান, “আমরা শুনেছি সেখানে বাড়িঘরের অবস্থা ভালো। কিন্তু আমরা সেই জায়গা দেখিনি। না দেখে কীভাবে সেখানে যাই?”

তিনি বলেন, “সরকারের উচিত আমাদের সেই জায়গা দেখানো। আবার এখান (উখিয়া) থেকে টেলিফোনে আরাকানে যারা এখনো বসবাস করছে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়। ওখানে গেলে সেটা হবে না। আমরা আমাদের দেশের কাছাকাছি থাকতে চাই।”

তবে আরেক রোহিঙ্গা নেতা আব্দুল আজিজ বেনারকে টেলিফোনে বলেন, “এখানে এক ঘরে আমরা ১২ জন মানুষ থাকি। পানি পাওয়া যায় না। টয়লেটে যেতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। ভাসানচরে ভালো সুবিধা থাকলে আমার যেতে আপত্তি নেই।”

সরকারি হিসাবে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

তাঁদের চাপে কক্সবাজার জেলার সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।

উখিয়ার স্থানীয় মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখ। কিন্তু সেখানে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। সেখানকার পানির স্তর নেমে গেছে। গাছপালা পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

আবার মিয়ানমার তাঁদের ফেরত নিতে চাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে নোয়াখালী জেলার ভাসানচরে উন্নতমানের আবাসন সুবিধাসহ এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আলাদা শিবির নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয় সরকার।

গতবছরের শেষ দিকে একনেকে ২৩১২ কোটি টাকার ভাসানচর প্রকল্প অনুমোদিত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীকে।

হবিবুল কবির চৌধুরী বলেন, ভাসানচরের মোট আয়তন ১৩,০০০ একর। এর মধ্যে ১,৭০০ একর জমিতে এক লাখ ‍রোহিঙ্গার জন্য বসতি নির্মাণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “১,৭০০ একর জমিতে এক লাখ মানুষ উন্নত সুবিধাসহ বসবাস করতে পারবে। পুরো জমি ব্যবহার করা গেলে সেখানে আরো এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে।”

ভাসানচরকে সাগরের পানি থেকে রক্ষা করতে চীনা কোম্পানি সিনোহাইড্রো বাঁধ নির্মাণ করেছে বলেও জানান তিনি।

হাবিবুল কবির বলেন, ভাসানচরে সুপেয় পানির জন্য পর্যাপ্ত নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। উখিয়ায় প্রতি ২২ জনে একটি টয়লেট। তবে, ভাসানচরে প্রতি ১১ জনে একটি টয়লেট। গোসল করার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত গোসলখানা।

তিনি জানান, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সন্দ্বীপ, হাতিয়া থেকে ট্রলারে চেপে ভাসানচর যাওয়া যাবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য সেখানে পুলিশ-আনসারসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকবে।

ভাসানচর প্রকল্পের পরিচালক কমোডোর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বেনারকে বলেন, বাঁধ নির্মাণের কারণে ভাসানচরে এখন স্বাদু পানির মাছ চাষ হচ্ছে। এখানকার মাটি অত্যন্ত উর্বর। ভাসানচর এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ।

তিনি জানান, বর্তমানে সেখানে ১,৪৪০ টি ক্লাসটার হাউজ রয়েছে। প্রতিটি ক্লাসটারে ১২টি বাড়ি রয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে ১৬টি ঘর। প্রতিটি ঘরে চারজন হিসাবে একটি বাড়িতে ৬৪ জন মানুষ বাস করতে পারবে।

কমোডোর মামুন বলেন, ক্লাসটার হাউজ ছাড়াও সেখানে রয়েছে পর্যাপ্ত ঘুর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৩টি পরিবার বসবাস করতে পারবে।

সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নের এ প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের নভেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।

কুড়ি বছর আগে বঙ্গোপসাগরের মুখে জেগে ওঠা ঠেঙ্গারচর নামে পরিচিত ভাসানচরে কোনো জনবসতি নেই। কারণ চরটি বছরের একটি সময় পানির নিচে চলে যেত।

ইঞ্জিনচালিত নৌযান ছাড়া সেখানে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে সেখানে যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগে।

চরটি আগে মূলত গরু-মহিষের চারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২০১৩ সালে এ চরকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।