রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বাংলাদেশের একার নয়: মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.15
ঢাকা
201015-BD-biegun-620.jpg ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সফররত মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান [বামে] ১৫ অক্টোবর ২০২০।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন; এই বোঝা বহন করার দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের একার নয় বলে মন্তব্য করেছেন সফররত মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান।

বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অনুদান সংগ্রহে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উদ্যোগে আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিতব্য দাতাদের সভার আগে তিনি এমন মন্তব্য করলেন।

সাংবাদিক সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর প্রথম দিন থেকে আমেরিকা বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে আসছে।

বুধবার বিকালে ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে বাংলাদেশে আসার পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সাথে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন বিগান।

দুই ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা ছাড়াও বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা, গণতন্ত্র ও সুশানসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী আলোচনা করেন দুই কর্মকর্তা।

‘কেন্দ্রস্থল’ হবে বাংলাদেশ

বিগান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে এবং একটি স্বাধীন ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তুলতে ও এগিয়ে নিতে আমরা নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

বিগান বলেন, “বাংলাদেশ এই অঞ্চলে আমাদের কাজের কেন্দ্রস্থল হবে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, “কক্সবাজারে বিশাল শরণার্থী জনগোষ্ঠীর অবস্থানের ফলে তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমাধান খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি।”

বিগান বলেন, শুধু শরণার্থী জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানো নয় বরং এই সমস্যার মূল কারণগুলো বের করে যৌথ প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের জনগণকে এই সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র।

তিনি বলেন, তাঁর সরকার এমনভাবে কাজ করছে যাতে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝা আর বহন করতে না হয়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই সহায়ক অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশের পাশে থাকবে।

বিগান বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র বরাবর খুব কঠোরভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোরও উচিত যুক্তরাষ্ট্রের মতো খোলাখুলিভাবে মিয়ানমারের সাথে এব্যাপারে কথা বলা।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ করার পাশাপাশি তাঁদের প্রয়োজনীয় মানবিক সহয়তা সংগ্রহের লক্ষ্যে একসাথে কাজ করবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র।

রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে আগামী বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে সভার আয়োজন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। বাংলাদেশকেও এই সভায় আমন্ত্রণ জানান হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা এ বছরের জন্য এক বিলিয়ন ডলার সাহায্যের আবেদন জানায়। তবে এর অর্ধেকের কম সহয়তা মিলিছে। এই প্রেক্ষাপটে তহবিল সংগ্রহের এই সভা আহ্বান করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এই সভা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বিগান বলেন, বাংলাদেশে অবস্থান করা শরণার্থীদের জরুরি মানবিক চাহিদা মেটাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পর্যাপ্ত অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এই সভা।

তিনি বলেন, “তবে, আমি আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই যে, এটিকে আমরা এই সংকটের দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান মনে করি না।”

বর্তমানে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করা মানুষদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁদের দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান খুঁজে বের করা দরকার,” বলেন বিগান।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে আমাদের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় এককভাবে প্রধান দাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালের আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা হিসেবে দেশটি এখন পর্যন্ত ৮২ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে, যার মধ্যে ৬৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য।

'প্রথম থেকে বাংলাদেশকে সমর্থন করছে যুক্তরাষ্ট্র'

সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েই চলেছে। এর অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান।

তিনি বলেন, আরেকটি কারণ হলো দীর্ঘদিন ধরে থাকা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর প্রথম দিন থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সমর্থন করে আসছে। এখনও তারা সহয়তা দিয়ে যাচ্ছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের পর দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বিগান।

রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, বিগানের সাথে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের তাঁদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। তিনি এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সহয়তা কামনা করেন।

কূটনীতিকদের মতে, বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির কেন্দ্র বলা তাৎপর্যপূর্ণ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান মুনশি ফায়েজ আহমাদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের সাথে সকল ধরনের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিগান ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। এবং এখানে এসে বাংলাদেশকে এই নীতির কেন্দ্র বলা তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশকে এই মাসে ইন্দো-প্যাসিফিক বিজনেস ফোরামের সভায় আমন্ত্রণ জানান হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য। আমরা যেন কোনো রকম রাজনৈতিক অথবা সামরিক ব্লকে অন্তর্ভুক্ত না হই। কারণ আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।”

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মনিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “ইন্দো-প্যাসিফিক ফোরামে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ সুবিধা তুলে ধরে মার্কিন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারি।”

তিনি বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশে চীনাদের বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে আমেরিকান ব্যবসা আনতে পারলে আমরা উপকৃত হব। এছাড়া, এই সুযোগে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দর কষাকষি করে জিএসপি সুবিধা পুনরুদ্ধার করতে পারি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।