রোহিঙ্গা শিবিরে ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ গতিবিধি জানতে দুর্গম এলাকায় ক্যামেরা

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2022.10.17
কক্সবাজার ও ঢাকা
রোহিঙ্গা শিবিরে ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ গতিবিধি জানতে দুর্গম এলাকায় ক্যামেরা টেকনাফের জাদিমুরায় ওয়াচ টাওয়ার থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে নজরদারি করছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। ১৬ জুলাই ২০২২।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

মিয়ানমারের রাখাইনে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের প্রভাবে সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি সামলাতে কক্সবাজারের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিবিরগুলো সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আনার চেষ্টা শুরু করেছে পুলিশ।

রাখাইনের সাম্প্রতিক সংঘর্ষ-সহিংসতার প্রেক্ষিতে “দুষ্কৃতিকারীরা মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা দুর্গম এলাকায় টিকতে না পেরে রোহিঙ্গা শিবিরে এসে আধিপত্য বিস্তারের” চেষ্টা করছে বলে সোমবার বেনারকে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-৮) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ।

তারা শরণার্থী নেতাদেরসহ “সাধারণ রোহিঙ্গাদের হুমকি দিচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ সংগঠিত করছে,” জানান তিনি।

তিনি জানান, এমন পরিস্থিতিতে পাহারা জোরদার করার পাশাপাশি শিবিরগুলোর দুর্গম পাহাড়ি এলাকা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে নিয়ে আসতে ‘সাম্প্রতিক সময়ে’ সিসি ক্যামেরা সংযোজন করা হয়েছে।

তবে কোন কোন ক্যাম্পে কতগুলো ক্যামেরা লাগানো হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।

রোহিঙ্গা নেতা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) উপস্থিতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রয়েছে বলে জানালেও আরসার কথা উল্লেখ না করে ফারুক আহমেদ বলেন, “দুষ্কৃতকারীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।”

“শিবিরের যেসব রোহিঙ্গা নেতা দুষ্কৃতিকারীদের সাহায্য করছে না, তাঁদের ‘টার্গেট’ করে হত্যা করা হচ্ছে,” বলেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ কারণেই শনিবার উখিয়ায় খুন হয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আনোয়ার (৩৮) ও মৌলভী মোহাম্মদ ইউনুস (৩৭)।

ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে চারজনকে গ্রেপ্তারের কথা বলেছে এপিবিএন। তবে সোমবার রাত আটটা পর্যন্ত তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

বাংলাদেশের জন্য ‘ভয়াবহ হুমকি

রাখাইনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে আরসা রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা “বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক।

তাঁর মতে, “তারা শিবিরগুলোয় হত্যাকাণ্ডের মতো আরো অনেক সহিংসতা ঘটাতে পারে, যেমনটা তারা এর আগেও করেছে।”

আরসার নাম উল্লেখ না করে এপিবিএন কর্মকর্তা ফারুক বেনারকে বলেন, এই ‘দুর্বৃত্তরা’ রোহিঙ্গা নেতা ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভয় দেখিয়ে “মাদক ব্যবসা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে চায়।”

নিরাপত্তার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুতুপালং-বালুখালীর বিভিন্ন শিবিরের একাধিক মাঝি সোমবার বেনারকে জানান, আরসা ক্রমাগত তাঁদের সহযোগিতা চাচ্ছে। বিশেষত ক্যাম্পগুলোয় রোহিঙ্গাদের দোকানগুলো থেকে মাসোহারা পেতে চায় তারা।

“আগে প্রকাশ্যে আরসা বিরোধিতাকারী রোহিঙ্গা নেতারাই শুধু আক্রান্ত হতেন, এখন তাদের সমর্থন না করলেই আক্রমণ করা হচ্ছে,” বলেন বালুখালীর একটি শিবিরের হেডমাঝি।

“দুষ্কৃতিকারী সংগঠনটি নতুন সদস্য সংগ্রহ শুরু করেছে। তাদের সাথে যোগ না দিলে হত্যার হুমকিও দিচ্ছে,” বলেন ৮-এপিবিএনের কর্মকর্তা ফারুক।

হুমকি পাওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নিরাপত্তা চেয়েছেন জানিয়ে সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক বলেন, “আমরা তাঁদের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি।”

দুষ্কৃতিকারীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডসহ তাদের যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আমাদের পর্যাপ্ত সদস্য মাঠে রয়েছেন।”

জুলাই থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত ১৭ খুন

এপিবিএন কর্মকর্তাদের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ার পাশাপাশি গত অক্টোবর থেকে শিবিরগুলোয় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছাসেবীদের পাহারা শুরুর কারণে দুষ্কৃতিকারীরা অনেকটাই কোণঠাসা।

সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় আরসার হাতে গত জুলাই থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে আরসা বিরোধী ছয়জন মাঝিসহ অন্তত ১৭ জনকে খুন করা হয়েছে, যাদের মধ্যে সাত জন ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক।

শিবির এলাকায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাও বেড়েছে। টেকনাফ নয়াপাড়া ক্যাম্পে ২ আগস্ট এক পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হন। বালুখালীর নৌকার মাঠ এলাকায় ১৭ সেপ্টেম্বর আরেক সদস্যকে কোপানো হয়।

সর্বশেষ ৪ অক্টোবর ১৮ নম্বর শিবিরে পুলিশের ওপর সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণের ঘটনায় আট বছরের এক রোহিঙ্গা শিশু নিহত হয়।

একাধিক শিবিরে গত ৯ অক্টোবর আরসার প্রকাশ্য ‘হ্যাপি ডে’ (খুশির দিন) কর্মসূচি আয়োজনে জড়িত থাকায় গত সপ্তাহে বালুখালীর ১০ নম্বর শিবির থেকে আটক হওয়া দুই রোহিঙ্গাও জিজ্ঞাসাবাদে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ফারুক।

উখিয়ার শিবিরগুলোর যেসব বাসিন্দা তাদের সহায়তা করছে, এমন অনেকেই ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

Shayon
2022-10-18 03:06

The fundamental human rights of Rohingyas are routinely violated. Their nation's government ought to give the state back control over their rights. To achieve this, international action is required.