সংকটে রোহিঙ্গা শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবা

প্রাপ্তি রহমান, জেসমিন পাপড়ি ও তুষার তুহিন
2017.10.18
ঢাকা ও কক্সবাজার
এক হাতে মাথায় বস্তা ধরে অন্য হাতে ছোট বোনকে আঁকড়ে রেখে হাঁটু পানি পেরিয়ে আঞ্জুমানপাড়ায় প্রবেশ করছে এক রোহিঙ্গা শিশু। এক হাতে মাথায় বস্তা ধরে অন্য হাতে ছোট বোনকে আঁকড়ে রেখে হাঁটু পানি পেরিয়ে আঞ্জুমানপাড়ায় প্রবেশ করছে এক রোহিঙ্গা শিশু। ১৮ অক্টোবর ২০১৭।
তুষার তুহিন/বেনারনিউজ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সংঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সেবাসংস্থাগুলো।

“রোহিঙ্গা শিশুদের পুষ্টিহীনতা মারাত্মক। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। প্রতিদিন নতুন করে রোহিঙ্গারা আসছে। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ৫০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তবু হিমশিম খেতে হচ্ছে,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম।

“রোহিঙ্গা শিশুদের অধিকাংশ জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া আমাশয়, পেটের ব্যথা, চর্মরোগ, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত,” বেনারকে বলেন উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মেজবাহ উদ্দিন।

এদিকে জরুরিভাবে ত্রাণ সরবরাহ করা না গেলে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য জীবন রক্ষাকারী ও সুরক্ষামূলক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।

মঙ্গলবার জেনেভা থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মুখপাত্র মারিক্সি মারক্যাডো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের জীবন রক্ষায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।

মারিক্সি মারক্যাডো বলেন, এখন পর্যন্ত আসা ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর ৬০ ভাগই শিশু। জীবনরক্ষায় তাদের চাহিদার তুলনায় যোগান দিনকে দিন কমে আসছে। ইউনিসেফ শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে আবারও সহায়তা চেয়েছে।

“আজকে পর্যন্ত ইউনিসেফ শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায় আগামী ছয় মাসে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ৭৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা চেয়েছিল। এখন পর্যন্ত চাহিদার সাত শতাংশ পাওয়া গেছে,” মারিক্সি মারক্যাডো বলেন।

মারিক্সি বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের বেঁচে থাকার জন্য যে আশ্রয়, খাদ্য, পানি, ভ্যাকসিন, সুরক্ষা তা আগামীকাল, আগামী সপ্তাহ বা আগামী মাসে নয়, বরং এখনই প্রয়োজন।”

উখিয়ার তাজমিনারকাটায় রাস্তার ধারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল রোহিঙ্গা শিশু। ১১ অক্টোবর ২০১৭।
উখিয়ার তাজমিনারকাটায় রাস্তার ধারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল রোহিঙ্গা শিশু। ১১ অক্টোবর ২০১৭।
তুষার তুহিন/বেনার নিউজ

সহযোগিতা না পেলে যা ঘটতে পারে

জরুরি সহায়তা না পেলে, নিরাপদ পানি, টয়লেট, তীব্র ও মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের খাদ্য, ভ্যাকসিনের সংকট দেখা দেবে।

বিবৃতিতে মারিক্সি বলেন, “নভেম্বরে শেষার্ধে শরণার্থী শিবিরে নিরাপদ পানির সংকট দেখা দেবে। এই মুহূর্তে ৪০ হাজার মানুষের কাছে ট্রাকে করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এই সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।”

“সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জন্য অতিরিক্ত ১৪০০টি পয়েন্ট প্রস্তুত করার কথা ছিল। সেগুলো করা যাবে না। উপদ্রুত এলাকার আড়াই লাখ মানুষের জন্য যে অতিরিক্ত ১২ হাজার টয়লেট বসানোর কথা ছিল সেটা বসানো যাবে না,” বলেন তিনি।

ইউনিসেফের মূল্যায়নে ১৫ হাজার তীব্র ও মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর জন্য রেডি-টু-ইউজ থেরাপিউটিক খাবার কেনা প্রয়াজন। এই খাবার কেনাও সম্ভব হবে না। তাছাড়া, ৮০ হাজার শিশু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

পানিবাহিত রোগের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জনশক্তি ও ওষধু পাওয়া যাবে না। এক লাখ নতুন আসা শিশু হাম, রুবেলা ও পোলিও টিকা পাবে না। পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুদের জন্য যে সেবা প্রয়োজন সেটাও দেওয়া সম্ভব হবে না বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।

বিশুদ্ধ পানীয় জল ও স্যানিটেশন সমস্যা তীব্র

কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখা যায়, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় রোহিঙ্গারা নানা সমস্যায় পড়ছে। দাতা সংস্থার সহযোগিতায় সরকার ১১ হাজার টিউবওয়েল ও ৪০ হাজার টয়লেট তৈরির পরিকল্পনা করেছে। তবে সে পরিকল্পনা এখনো পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। এখন পর্যন্ত ১০৫৯৭টি টয়লেট ও ৩৮০২টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।

শিবিরগুলোয় সবচেয়ে বেশি সংকটে থাকতে দেখা গেছে শিশুদের। ছোট ছোট শিশুদের দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে দেখা গেছে। বালুখালী রোহিঙ্গা পল্লীর আব্দুল হাকিম মাঝি বেনারকে বলেন, “খাবার পানির জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। টয়লেট নেই পর্যাপ্ত।”

অনাহারে, অর্ধহারে ও বৈরি আবহাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ

উখিয়ার সীমান্ত এলাকায় সদ্য অনুপ্রবেশকারী প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা কষ্টে আছেন। এক সপ্তাহ হেঁটে এপারে আসার পর প্রতিকূল পরিবেশ ও খাদ্যের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে বড় অংশ। এদের মধ্যে শিশু আর বৃদ্ধের অবস্থা সব চাইতে নাজুক।

দুই শিশুকে কোলে নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে পাহাড় জঙ্গল ও খাল বিল পেরিয়ে মঙ্গলবার উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়ায় প্রবেশ করেছে রাখাইনের বুচিদংর মগনামা গ্রামের স্বামী হারা শফিকা (২৫)।

“ভেবেছিলাম এপারে পৌঁছাতে পারলে হয়তবা দুমুঠো খেতে পারব। মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে। কিন্তু এপারে পার হয়েও এখনো কিছু খাইনি,” শফিকা বেনারকে বলেন।

এদিকে রাখাইনের বুচিদংয়ের জাদিপাড়া গ্রামের রহমত উল্লাহর ছেলে আক্কাস (৩৫) বেনারকে জানান, সপ্তাহখানেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এপারে এসে খোলা আকাশের নিচে ধানক্ষেতের আইলে অবস্থান নিয়েছেন।

৩৪ বিজিবি’র অতিরিক্ত অধিনায়ক মেজর ইকবাল বেনারকে বলেন, “আঞ্জুমান পাড়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের আপাতত এখানেই রাখার নির্দেশনা রয়েছে। তাদের জন্য কুতুপালংয়ে শেড নির্মাণ শেষ হলে সরাসরি সেখানে পাঠানো হবে।”

ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা বেনারকে জানান, আঞ্জুমানপাড়ায় অবস্থানরত শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে ডায়রিয়া, সর্দি কাশি ও জ্বর দেখা দিয়েছে। এদের দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা দরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।