পুলিশের ধারণা, মুহিব উল্লাহ হত্যা এবং মাদ্রাসায় ছয় রোহিঙ্গা খুন একই দলের কাজ

আহম্মদ ফয়েজ ও আব্দুর রহমান
2021.10.25
ঢাকা ও কক্সবাজার
পুলিশের ধারণা, মুহিব উল্লাহ হত্যা এবং মাদ্রাসায় ছয় রোহিঙ্গা খুন একই দলের কাজ জানাজা শেষে উখিয়া বালুখালী শরণার্থী শিবিরে নিহত ছয় রোহিঙ্গাকে দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ২৩ অক্টোবর ২০২১।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যা এবং মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ছয় শরণার্থী হত্যার ঘটনা একই সন্ত্রাসী গ্রুপের কাজ বলে ধারণা করছে পুলিশ।

এই দুটি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া খুনিদের প্রায় সবার নাম-ঠিকানাই হাতে এসেছে বলেও দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, যদিও তা প্রকাশ করেননি কর্মকর্তারা।

“রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যা এবং মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ছয় রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তারা একই গ্রুপের সদস্য বলে প্রাথমিকভাবে আমাদের (পুলিশ) কাছে মনে হচ্ছে,” সোমবার বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো.রফিকুল ইসলাম।

“খুনিদের নাম-ঠিকানা আমাদের হাতে রয়েছে, তবে বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না,” বলেন রফিকুল ইসলাম। 

এর আগে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজার ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক নাঈমুল হক বলেন, “পুলিশের ধারণা দুটি কিলিং মিশনই পরিকল্পিত এবং একই গ্রুপের কাজ হয়ে থাকতে পারে।”

“মুহিব উল্লাহ হত্যার পর থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে পুলিশ এ পর্যন্ত ৮৬ জন রোহিঙ্গাকে মাদক ও বিভিন্ন ধারালো অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ,” বেনারকে জানান নাঈমুল হক।

মুহিব উল্লাহ হত্যার পর শরণার্থী শিবিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার থাকার পরও কীভাবে ছয়জনকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “‘ক্যাম্পগুলো খুবিই ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ার সুবাদে অপরাধীরা এ সুযোগ পেয়েছে।”

“তবে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। যেমন মুহিব উল্লাহ হত্যাকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল।কিন্তু অবশেষে আমরা তাদের ধরতে সক্ষম হয়েছি,” বলেন তিনি।

অপরাধীদের ধরতে শরণার্থী শিবির এলাকায় অভিযান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যখন সকল অপরাধী ধরা পড়বে, হয়তো এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।”

এদিকে ছয় খুনের ঘটনাকে একটি “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” দাবি করে কক্সবাজার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমরা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি এবং সেখানে পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। তবুও এমন একটি ঘটনা ঘটে যাওয়া খুবই দুঃখজনক।” 

দুই মিনিটেই শেষ মুহিব উল্লাহ হত্যা মিশন 

মুহিব উল্লাহ হত্যার ঘটনায় নতুন করে চার আসামিকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে নাঈমুল হক বলেন, “রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করার কারণেই খুনিদের টার্গেটে পরিণত হন জনপ্রিয় এই রোহিঙ্গা নেতা।”

তিনি জানান, এই হত্যাকাণ্ডে সর্বমোট ১৯ সন্ত্রাসী অংশ নেয় এবং তারা মাত্র দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই হত্যা মিশন শেষ করে পালিয়ে যায়।

পুলিশ জানায়, হত্যার দু'দিন আগে ২৭ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে উখিয়ার মরকস পাহাড়ে একটি মিটিং হয়। সেখানে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া আজিজুল হকসহ আরও চার জন উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পরিকল্পনা করা হয় মুহিব উল্লাহকে হত্যার। এরই অংশ হিসেবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া নিজ কার্যালয়ে ঢুকে মুহিব উল্লাহকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করেছিলেন আজিজুল। 

পুলিশ জানায়, মুহিব হত্যায় অংশ নেয়া ১৯ জনের মধ্যে আজিজুল ছাড়া কুতুপালং এর আব্দুল মাবুদের ছেলে মোহাম্মদ রশিদ প্রকাশ মুরশিদ আমিন, ফজল হকের ছেলে মোহাম্মদ আনাছ ও নুর ইসলামের ছেলে নুর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

“এশার নামাজের পর প্রত্যাবাসন বিষয়ে কথা আছে বলে মুহিব উল্লাহকে ডেকে নিয়ে যান মুরশিদ আমিন। এরপর সেখানে পৌঁছান মো. আনাছ ও নুর মোহাম্মদ। তারা মুহিব উল্লাহকে হত্যার জন্য দুর্বৃত্তদের ঘটনাস্থলে আসার সংকেত দেন। এ সময় মুখোশধারী সাতজনের মধ্যে তিনজন অস্ত্রধারী মুহিব উল্লাহর অফিস কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করেন,” বলেন নাঈমুল হক।

তিনি বলেন, “অফিসের দরজায় অবস্থান নেন অস্ত্রধারী মো. আনাছ, নুর মোহাম্মদ, আজিজুল হক ও অপর একজন। মুহিব উল্লাহ তখন ১০-১৫ জন সঙ্গীসহ অফিসের ভেতরে ছিলেন।”

“অস্ত্রধারীদের তিনজনের একজন মুহিব উল্লাহর কাছে গিয়ে বলেন, মুহিব উল্লাহ, ওঠ। মুহিব উল্লাহ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালে প্রথম একজন একটি গুলি ছোড়ে। গুলিটি মুহিব উল্লাহর বুকে লাগে। এরপর আরেকজন দুটি গুলি ছোড়ে। এরপর আরও একটি গুলি ছোড়া হয়। মুহূর্তে মুহিব উল্লাহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন,” বলেন নাঈমুল হক।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৯টার দিকে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিব উল্লাহকে তাঁর আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা।

এর পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ২৫ জনকে আসামি করে উখিয়া থানায় মামলা করেন। 

‘দোষ স্বীকার করেছে আরেক খুনি’ 

মুহিব উল্লাহ খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত নয় রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্য মোহাম্মদ ইলিয়াছ কক্সবাজার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন গত ১০ অক্টোবর।

সর্বশেষ গত ২৩ অক্টোবর শনিবার হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আজিজুল হক কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জেরিন সুলতানার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

“আদালত দেওয়া জবানবন্দিতে আজিজুল হক বলেছেন, ঘটনার সময় অস্ত্র নিয়ে মুহিব উল্লাহর অফিসে প্রবেশ করেন তিনি সহ আরও কয়েকজন। তাঁকে (মুহিব উল্লাহ) তিন রাউন্ড গুলি করেন মূল পরিকল্পনাকারী আবদুর রহিম। আবদুর রহিমের গুলিতে মুহিব উল্লাহর মৃত্যু নিশ্চিত হলে তাঁরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন,” বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম। 

এদিকে গত শুক্রবার ভোরে উখিয়ার বালুখালীর এক শরণার্থী শিবিরে একটি মাদ্রাসায় গুলি করে ও কুপিয়ে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় শনিবার রাতে উখিয়া থানায় মামলাটি করেন ওই ঘটনায় নিহত আজিজুল হকের বাবা নুরুল ইসলাম। 

মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরও ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার ওসি সনজুর মোরশেদ। ওই ছয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে এ পর্যন্ত ১০ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।