শরণার্থী শিবিরে টার্গেট কিলিং থামেনি, দুই দিনে তিন রোহিঙ্গা খুন

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2022.10.27
ঢাকা ও কক্সবাজার
শরণার্থী শিবিরে টার্গেট কিলিং থামেনি, দুই দিনে তিন রোহিঙ্গা খুন কক্সবাজার উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের টহল। ২৬ অক্টোবর ২০২২।
[সৌজন্যে: এপিবিএন]

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমারভিত্তিক উগ্রবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।

পুলিশ ও স্থানীয়দের হিসাবে, চলতি মাসে এক শিশুসহ নয় রোহিঙ্গা আরসার হাতে প্রাণ হারিয়েছেন, আর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন রোহিঙ্গা।

আরসার সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে পাঁচ বছর আগে রাখাইন রাজ্য থেকে কমপক্ষে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ রাখাইন গোষ্ঠী। বাংলাদেশে তাঁরা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেলেও নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে গুলি করে দুই রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে আরসা সন্ত্রাসীরা। নিহতরা হলেন; মো. ইয়াছিন (৩০) ও মো. আয়াত উল্লাহ (৪০)।

এর আগে বুধবার আরসার সদস্যরা জসীম (২৯) নামে এক রোহিঙ্গাকে গুলি করে, এরপর তিনি মারা যান।

শরণার্থী শিবিরে চলতি মাসে নিহত রোহিঙ্গারা কথিত আরসার হাতেই খুন হয়েছেন বলে বেনারকে জানান ৮-এপিবিএন এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ।

তিনি বেনারকে বলেন, মূলত আধিপত্য বিস্তার, গ্রুপিং এবং প্রশাসনকে সহযোগিতার জের ধরে ক্যাম্পে হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

ঘরে গিয়ে গুলি

শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক সৈয়দ হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, উখিয়ার ১৭ নম্বর শিবিরের ইরানী পাহাড় এলাকায় ওই দুই রোহিঙ্গাকে তাঁদের নিজ ঘরে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার ভোর তিনটার দিকের ওই আক্রমণে মো. ইয়াছিন ঘটনাস্থলেই মারা যান। এপিবিএন সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে আহত আয়াত উল্লাহকে এমএসএফ হাসপাতালে পাঠালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত আয়াত উল্লাহ’র ভাই সালামত উল্লাহ বেনারকে বলেন, “সন্ত্রাসীরা যখন আসে তখন আমার ভাই ঘুমে ছিলেন। এ সময় মুখোশ পরা সন্ত্রাসীরা এসে আমার ভাইকে গুলি করে। মুখোশ পরা থাকায় কাউকে চেনা যায়নি।”

তিনি বলেন, “ঘরে ঢোকার আগে প্রায় এক ঘণ্টা ক্যাম্পের বাইরে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করা হয়। পরে ঘরে ঢুকে তারা আমার ভাইকে গুলি করে পালিয়ে যায়।”

নিহত ইয়াছিনের ভাই মো. হোছেন বেনারকে বলেন, “আয়াত উল্লাহ নামে আজ যাকে হত্যা করেছে, মাস দুয়েক আগে তাঁর এক ভাইয়ের হাত পা কেটে দেয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পর আমার ভাই ইয়াছিন পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। এ ঘটনার জের ধরে সন্ত্রাসীরা তাঁকে টার্গেট করে হত্যা করেছে।”

ইয়াছিনকে মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা আমাকেও ধরতে চেয়েছিল, কিন্তু দ্রুত পালিয়ে যাওয়ায় আমাকে ধরতে পারেনি।”

চলতি মাসেই ৯ হত্যাকাণ্ড

এপিবিএন কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ বলেন, “১০ অক্টোবর, আরসা সন্ত্রাসীরা জামাল হোসেন নামের এক রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পের মধ্যে হত্যা করে। তাঁর ছেলে সৈয়দ হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। আট দিন পর (১৮ অক্টোবর) তারা সৈয়দ হোসেনকে হত্যা করে।”

“ক্যাম্পে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, সেগুলো মূলত আরসার কাজ,” বলেন ফারুক আহমেদ।

কক্সবাজার এপিবিএন এর দেওয়া তথ্য মতে, চলতি অক্টোবর মাসে মো. ইয়াছিন, আয়াত উল্লাহ ও মোহাম্মদ জসিম ছাড়াও রোহিঙ্গা শিবিরে এক শিশুসহ নয়জন খুন হয়েছেন।

রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চলতি মাসে ছয়টি মামলা হয়েছে বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার ওসি শেখ মো. আলী।

রোহিঙ্গা শিবিরে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কথা জানিয়ে বালুখালী ৯ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মাস্টার শফি উল্লাহ (৫০) বেনারকে বলেন, “কোন দিন কার ওপর কী বিপদ আসে, বুঝতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি।”

রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও শঙ্কায় রয়েছেন জানিয়ে কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এখন টার্গেট কিলিং হচ্ছে। তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আমরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীও অসহায় হয়ে পড়েছি।”

“রাতের বেলায় শিবিরে পাহারা ব্যবস্থায় যারা সক্রিয় আছে, যারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছে, যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে তথ্য দিচ্ছে তাদেরকে টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।

আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করছে?

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ও সংকট নিয়ে আলোচনা হয় বলে বেনারকে জানিয়েছেন কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান।

তিনি বলেন, “আরসা মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করছে। তারা রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে কাজ করছে। তারা প্রত্যাবাসনের পক্ষে যারা কাজ করছে তাদের হত্যা করছে।”

তবে তিনি তাঁর এই মতামতের কোনো ব্যাখ্যা দেননি।

ফারুক খান বলেন, “রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। কারণ তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ। রাখাইনে প্রত্যাবাসনই এই সঙ্কটের একমাত্র সমাধান।”

তিনি বলেন, “আজকের সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে থেকে জানানো হয়েছে, মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চায়। চীন এ ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করছে। আশা করছি শিগগির ভালো কিছু হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

Shayon
2022-10-28 06:19

Rohingyas living as refugees are harming both environment and law and order in Bangladesh. Although the Bangladesh government has helped the Rohingyas a lot, it is the responsibility of their state to return their state rights. Such as political rights, right to live in one's motherland, right to livelihood etc. These rights should be returned to them.