রোহিঙ্গা সংকট জঙ্গি ঝুঁকি বাড়াবে, আশঙ্কা টিআইবির

জেসমিন পাপড়ি
2017.11.01
ঢাকা
টেকনাফের মৌচনী নয়াপাড়া ক্যাম্পের মাঠে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন রোহিঙ্গারা। টেকনাফের মৌচনী নয়াপাড়া ক্যাম্পের মাঠে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন রোহিঙ্গারা। ২৩ অক্টোবর ২০১৭।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

চলমান রোহিঙ্গা সংকটের কারণে দেশে জঙ্গি ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এমন পরিস্থিতিতে শিগগিরই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

জীবন বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে আসা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দালালচক্রের হাতে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে বলেও জানায় টিআইবি।

টিআইবি পরিচালিত ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশে অবস্থানজনিত সমস্যা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিষয়ক সমীক্ষা’ প্রতিবেদন প্রকাশ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে বুধবার এসব তথ্য তুলে ধরেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়।

জঙ্গি ঝুঁকির আশঙ্কা

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সংকটের সুযোগে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগসাজশ প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি রয়েছে।”

তিনি বলেন “রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাংগঠনিক ক্ষমতা কাঠামো তৈরি হচ্ছে যা শুরু থেকে নিয়ন্ত্রণ না করলে একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।”

“পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা হলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নানা অপরাধ এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পাবে। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক নানাবিধ অপরাধে রোহিঙ্গাদের জড়িত করার ঝুঁকি রয়েছে,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন ইফতেখারুজ্জামান।

টিআইবি মনে করে, রোহিঙ্গা নারীদের যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে ফেলার ঝুঁকিসহ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে গেলে তা বহুমুখী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির কারণ হবে।

অবাধ সীমান্ত অতিক্রমের সুযোগ ব্যবহার করে মাদক চোরাচালান ও মানব পাচারসহ বিভিন্ন ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্যও এ সমীক্ষায় পাওয়া গেছে।
টিআইবির এ আশঙ্কার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিশ্লেষকেরাও। এ প্রসঙ্গে অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থান বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদসহ নানা ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। যার ফল ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা অপরাধকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে আটকও হয়েছে।”

এমন অবস্থায় তাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর উদ্যোগের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় পুলিশ টহল ক্যাম্প স্থাপনসহ পাহারা জোরদার করার সুপারিশ করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে “বিষয়টি নিয়ে আমরা সচেতন,” বলে মন্তব্য করেন কক্সবাজারে জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “নতুন প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা গত দুইমাসে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বিরাট এই ঢলের সঙ্গে রাখাইনের কিছু অপরাধীও এদেশে আসতে পারে। বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর রয়েছে।”

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের আশ্রয় দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করলেও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের একার পক্ষে এই বোঝা বহন সম্ভব নয় বলে মনে করে টিআইবি।

ইফতেখারুজ্জামান গৃহহীন ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বহনের এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের ওপর সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি’র কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষা তুলে ধরেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। ১ নভেম্বর ২০১৭।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি’র কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষা তুলে ধরেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। ১ নভেম্বর ২০১৭।
সৌজন্যে টিআইবি

প্রতারিত হচ্ছে রোহিঙ্গারা

টিআইবি জানায়, সীমান্ত অতিক্রম থেকে আশ্রয়স্থলে পৌঁছানো ও আশ্রয় শিবিরে পুনর্বাসন পর্যন্ত বিভিন্ন অসাধু চক্রের হাতে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতারণা ও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। প্রকৃত ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা হলেও, সীমান্ত পাড়ির সময় নৌকার মাঝিদের জনপ্রতি গড়ে ৫-১৫ হাজার টাকা অথবা অর্থের বদলে সোনার গয়না দিতে হচ্ছে।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক জানান, মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রতি এক লক্ষ কিয়াটের বিপরীতে ৬ হাজার টাকা প্রাপ্তির কথা থাকলেও দালালদের কাছ থেকে ২ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশি মুদ্রার মান না জানায় স্থানীয় যানবাহনেও তাদের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঘর নির্মাণের জন্যও প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারকে গড়ে ২-৫ হাজার টাকা একটি চক্রকে দিতে হয়েছে। প্রতিটি ধাপের প্রতারণার সঙ্গেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ঝুঁকিতে বসবাস

টিআইবি জানায়, মৌলিক চাহিদাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ বিশুদ্ধ পানি, পয়োনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যজনিত ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ইফতেখারুজ্জামান জানান, বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের ঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকায় ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য সহায়তার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসনের লোকবল সংকটের কারণে ত্রাণ বিতরণে কিছুটা অব্যবস্থাপনা রয়েছে বলে বেনারের কাছে স্বীকার করেন কক্সবাজারে জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।