কাজের সন্ধানে শরণার্থী শিবির ছাড়ছে হাজারো রোহিঙ্গা
2017.11.01
কক্সবাজার
সমুদ্রতীরে নিজের কুড়েঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন ফারহীম উর্মিন। বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত ঘেঁষে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য স্থাপিত জনবহুল শিবির থেকে জায়গাটি বেশ কয়েক মাইল দূরে। নিজের চাকরির প্রশ্ন বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
দীর্ঘক্ষণ অনুরোধের পর মুখ খোলেন ২৩ বছর বয়সী দুই সন্তানের এই জননী।
উর্মিন বেনারনিউজকে বলেন, “সম্প্রতি নিকটবর্তী একটি হোটেলে মাসিক চার হাজার টাকা বেতনে আমি গৃহস্থালির কাজ শুরু করেছি। আমার স্বামীও দৈনিক ২০০ টাকা মজুরিতে কাজ পেয়েছেন।"
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উর্মিন এবং তার স্বামী সম্প্রতি আগত হাজারো রোহিঙ্গার মধ্যে দুজন যারা কাজের সন্ধানে কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে শহরে এসেছেন।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে সহিংসতার পর পায়ে হেঁটে গত মাসে উর্মিনের পরিবার বাংলাদেশে এসেছে। কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া এলাকায় মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়ায় এক কক্ষের টিনের ঘর ভাড়া নিয়েছেন তারা।
স্থানীয় পৌরসভার কাউন্সিলর আখতার কামাল বেনার নিউজকে বলেন, “প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা সমিতি পাড়ায় বসবাস করছেন। এদের মধ্যে চার হাজারই নতুন এসেছেন। তারা অধিকাংশই চাকরি পেয়েছে।”
শরণার্থী স্বীকৃতি নেই, সহমর্মিতা আছে
বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত ২৫ আগস্ট ইসলাম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গাদের ওপর অভিযান শুরু করার পর থেকে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। কক্সবাজার শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১৫ টি ক্যাম্পে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এর আগে থেকে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে বসবাস করছেন আরো প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রহীন এই জনগোষ্ঠীকে বৌদ্ধ প্রধান মিয়ানমার নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না, বরং অবৈধ বাঙালি অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে।
এদিকে নিজের দেশে সহিংসতায় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও বাংলাদেশে তাঁদের শরণার্থী মর্যাদা যেমন স্বীকৃত নয়, তেমনি এখানে কাজ করারও অনুমতি নেই তাঁদের।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ‘শরণার্থী’ মর্যাদা দেবে না এবং তাঁদেরকে ‘রোহিঙ্গা’ না বলে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ হিসেবে উল্লেখ করবে বলে অক্টোবরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব সচিব শাহ কামাল।
তিনি বলেন “আমরা তাঁদের (রোহিঙ্গাদের) রিফিউজি (শরণার্থী) বলছি না। এই পরিচয়ের (বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক) কারণে ধরে নেওয়া হচ্ছে তাঁরা রিফিউজি নয়, তারা আমাদের এখানে আশ্রয় প্রার্থী।”
“তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিকও নয়, স্থায়ী বাসিন্দাও নয়। আইনত এখানে তাঁদের কাজ করার অনুমতি নেই,” বেনারকে বলেন র্যাব এর মেজর রুহুল আমিন।
“কিন্তু অনেকেই বড়ো শহরগুলোতে কাজ করছে বলে আমরা জানি। তাঁরা যখনই ধরা পড়ে তখন আমরা তাঁদের আবার শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দেই,” বলেন তিনি।
মেজর রুহুল আমিন বলেন, “আমরা তাঁদের গ্রেপ্তার করি না, কারণ তাঁরা যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে আমরা সহমর্মী। মানবিক দিক থেকে আমাদের বুঝতে হবে যে তারা একটা চরমতম সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”
কিছুই অবশিষ্ট নেই গ্রামে
মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত উর্মিনদের পুরো গ্রাম সেনাবাহিনীরা পুড়িয়ে দিয়েছে। উর্মিনের ভাষায়, “আমাদের গ্রামের কিছুই অবশিষ্ট নেই।”
তিনি জানান, টানা দশ দিন পায়ে হেঁটে পাহাড় এবং জঙ্গল অতিক্রম করে গত ৬ সেপ্টেম্বর তার পরিবার যখন উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থীশিবিরে পৌঁছায় তখন সেখানে রোহিঙ্গাদের উপচে পড়া ভিড় ছিল।
“সেখানে খুব ভিড় আর বিশৃঙ্খলা ছিল। আমরা একটি উন্মুক্ত আশ্রয়কেন্দ্রে কিছুদিন ছিলাম। কিন্তু সেখানে নিরাপদবোধ করিনি,” বলেন উর্মিন।
উর্মিনের পরিবার নতুন আগত আরও কিছু পরিবারের সঙ্গে কক্সবাজার শহরে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের জানানো হয় সেখানে আগেই আরও কিছু রোহিঙ্গা পালিয়ে বসতি স্থাপন করেছে এবং তারা কাজও পেয়েছে।
শরণার্থী ক্যাম্প থেকে শহরে যাওয়ার সড়কটি ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সংকীর্ণ। সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য তারা প্রত্যেকটি গাড়ি এবং এর যাত্রীদের পরিচয়পত্র চেক করছে।
উর্মিন বলেন, “আমরা রাস্তা দিয়ে (শহরে) আসিনি। সড়কের পাশ দিয়ে যে জঙ্গল আছে রাতের বেলা সেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসেছি।”
ব্যর্থতা স্বীকার করে কর্তৃপক্ষ
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী ক্যাম্পে সীমাবদ্ধ রাখতে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
র্যাবের মেজর রুহুল আমিন বেনার নিউজকে বলেন, “শরণার্থীরা যাতে শহরগুলোতে ঢুকতে না পারে সেজন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু গত দুই মাসে যে বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা ঢুকেছে সে তুলনায় এটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি বলেন, “শহরে যাওয়ার সময় প্রতিদিন অন্তত ১০০ রোহিঙ্গাকে আমরা আটক করছি। কিন্তু অনেকেই ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে।” তাঁর মতে এই সংখ্যা প্রথম দিকে আরও বেশি ছিল।
তিনি বলেন, “তারা বেপরোয়া। আমরা কতবার তাদের ধরছি এবং ক্যাম্পে পাঠাচ্ছি সেটা বিষয় নয়। তারা চেষ্টা চলিয়ে যায়।”
চোখের সামনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নিজের স্বামীকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যেতে দেখেছেন মোহসানা। এরপর দুই মাস আগে বাংলাদেশে এসেছেন। ২৫ বছর বয়সী মোহসানা এখন উর্মিনের প্রতিবেশী। তিন কন্যাকে নিয়ে গত মাসে তিনি উখিয়া উপজেলার বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্প থেকে কক্সবাজার শহরে ঢুকেছেন।
তিনি বেনার নিউজকে বলেন, “আমরা গাড়িতে করে এসেছি। তল্লাশি চৌকি এড়ানোর জন্য কয়েকবার গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটেছি।”
মোহসানা নিজের পুরো নাম বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, সমিতিপাড়ায় পৌঁছানোর একদিন পরই মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে একটি মাছের খামারে কাজ পেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমি দিনে অন্তত ৩০০ মাছের আঁশ ও নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করি। এরপর বাকশে ঢোকানোর জন্য মাছগুলো শুকিয়ে নেওয়া হয়। এখানে বসবাসকারী অধিকাংশ রোহিঙ্গাই এই কাজ করে।”
মোহসানা বলেন, “আমার শরীরে দুর্গন্ধ হয়। কিন্তু এটা আমার কাছে কিছু নয়। ক্যাম্পের জীবনের চেয়ে এটা অনেক ভালো। এই জায়গাটি শান্ত, পরিচ্ছন্ন এবং সমুদ্র সৈকতের পাশে। শিশুরা এখানে নির্ভয়ে খেলাধুলাও করতে পারে।”