রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে বিশেষ পদক্ষেপ
2017.11.02
ঢাকা ও কক্সবাজার
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী–পুরুষের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকায় ব্যাপক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় এ দেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসার বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ ছিলেন। এ বিষয়ে তাদের চরম অনাগ্রহ আমি দেখেছি। আমাদের কর্মীরা তাদের সঙ্গে কথা বলে, বুঝিয়ে মনোভাব পরিবর্তন করে অনেকটা ইতিবাচক করা সম্ভব হয়েছে।”
“এমনিতেই আগত রোহিঙ্গাদের অর্ধেকই শিশু। তার ওপরে রোহিঙ্গাদের জন্মহার অনেক বেশি। তাই রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী করা না গেলে বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়বে,” বেনারকে বলেন জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা।
প্রসঙ্গত ১৯৯০ এর দশক থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর এই কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করা হয়।
বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য দেশে অস্থায়ী ও স্থায়ী দুই ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সফলভাবে চালু রয়েছে, তবে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের জন্য বর্তমানে বিনামূল্যে শুধু তিনটি অস্থায়ী পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলে জানায় পরিবার পরিকল্পনা সূত্র।
“আপাতত তিন মাসের জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন, পিল ও কনডম সরবরাহ করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের,” বেনারকে জানান ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য।
পরিবার পরিকল্পনা সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা বিদেশী নাগরিক হওয়ায় তাঁদের জন্য স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুমতি লাগবে। তবে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।
ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেয়নি। যদি মন্ত্রণালয় তেমন কোনো নির্দেশনা দেয় তবে সেভাবেই বাস্তবায়ন করা হবে।”
বাড়ছে সচেতনতা
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পে ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরা গর্ভবতী, প্রসূতি, শিশু স্বাস্থ্য ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা বিষয়েও বিভিন্ন পরামর্শ ও ওষুধ সরবরাহ করছেন।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নতুন আসা রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার গর্ভবতী। তার মধ্যে ৮৫০ জন নারী মেডিকেল ক্যাম্পে সন্তান প্রসব করেছেন। এ ছাড়া দেড় হাজার নারী নিজ ঘরেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
“এ দেশে আসার পর প্রায় আট হাজার গর্ভবতী নারীকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করেছি আমরা। চেষ্টা চলছে মোটিভেশন ও কাউন্সেলিং এদের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা,” জানান আব্দুস সালাম।
“উখিয়া ও টেকনাফের ৬টি স্থায়ী ও ৭টি অস্থায়ী কেন্দ্র থেকে রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী করে তোলার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের প্রায় আড়াই শ’ স্বাস্থ্যকর্মী ক্যাম্পে-ক্যাম্পে গিয়ে নতুন আসা দেড় লাখ নারী-পুরুষকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সচেতন করছেন,” বেনারকে বলেন ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য।
তিনি জানান, “ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে সাত হাজারের মতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮ শ’ রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিরোধক ইনজেকশন, ২ হাজার ৯ শ’ নারীকে জন্মনিরোধক ট্যাবলেট ও ৬ শ ৯৭ জন পুরুষকে কনডম সরবরাহ করা হয়েছে।”
“রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে সচেতন করে তোলা করা দুরূহ ব্যাপার,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মী সুমাইয়া বেগম।
“শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকা এই গোষ্ঠীটি ধর্মীয় গোঁড়ামিতে নিমজ্জিত। তাদের কাছে সন্তান আল্লাহর দান। তাই তাতে বাধা দেওয়া মহাপাপ। এতে আল্লাহ রুষ্ট হন বলে মনে করে রোহিঙ্গারা,” বলেন সুমাইয়া।
দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা মুক্তি। এর কর্মী সাইফুল আজাদ বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতন করা অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবং এর সুফলও কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে।”
রাখাইনে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাখাইনে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই।
“একেক রোহিঙ্গা পরিবারে কমপক্ষে ৫-১০ জন সন্তান রয়েছে। তারা পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে একদমই সচেতন না,” বেনারকে বলেন বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সুপারভাইজার মো. মুকলেছুর রহমান আকন্দ।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে দেখা হয় রোহিঙ্গা নারী সকিনা বেগমের (৩৫) সঙ্গে। মঙ্গলবার শাহপরীর দ্বীপ হয়ে কুতুপালং এসে পৌঁছেছেন তিনি।
তিনি বেনারকে জানান, ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর বর্তমানে সাত মেয়ে ও তিন ছেলে রয়েছে। ইতিমধ্যেই চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তার ধারণা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এমন শব্দ এর আগে শুনিনি।”
“রাখাইনে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ সম্পর্কে আমরা জানিও না। বাংলাদেশে আসার পর বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারি,” বেনারকে বলেন মধুরছড়ার গোলশান পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া ৬ সন্তানের জননী সুফিয়া।
“এ বিষয়ে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি রাজি হননি,” জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার সম্পর্কে বলেন সুফিয়া।
“আমার স্ত্রী বলে সন্তান হলে আমি না নেওয়ার কে?”- জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনাগ্রহের কথা এভাবেই বেনারের কাছে প্রকাশ করেন তিন সন্তানের জনক সাদ্দাম।
তবে পরিবার পরিকল্পনার কর্মীদের কাউন্সেলিংয়ের পর জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বেশ কিছু রোহিঙ্গা। তাদেরই একজন তিন সন্তানের জননী ফাতেমা খাতুন (২৫)।
ফাতেমা বেনারকে বলেন, “আমরা তো মিয়ানমারে এসব কখনো গ্রহণ করিনি। আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারপরও এ দেশের স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শে আমি তিন মাসের ইনজেকশন নিয়েছি।”