টাকার লোভে রোহিঙ্গা পারাপারে ঝুঁকি নিচ্ছে বাংলাদেশের মাঝিরা
2017.11.02
কক্সবাজার
পুলিশি অভিযানের তোয়াক্কা না করে প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গাকে ক্ষুদে নৌকায় ভাসিয়ে মিয়ানমার থেকে সীমান্তের এপারে নিয়ে আসছেন বাংলাদেশের মাঝিরা। এভাবে নদী ও সমুদ্রসীমা পাড়ি দিতে গিয়ে শুধু দুই মাসে প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এভাবে সাগর পাড়ি দেওয়া বন্ধ করতে নৌকাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে বাংলাদেশের পুলিশ। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
বেনার নিউজের একদল সাংবাদিক বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের একদম দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দক্ষিণ পাড়া গ্রামে গিয়ে তিন ঘণ্টায় অন্তত ১০০ মানুষকে এভাবে ছোট ছোট নৌকায় পাড়ি দিতে দেখেছেন। সাগর পাড়ি দেওয়া মানুষগুলোর অধিকাংশই নারী ও শিশু।
শরণার্থীরা বলেছেন, মিয়ানমার থেকে গভীর রাতে তাঁদের নৌকায় তোলা হয়। প্রথমে তাঁদের শাহপরীর দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়। শাহপরীর দ্বীপ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি জেলে পাড়া। ওই দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে বঙ্গোপসাগর।
এই স্থানেই গত ২৮ সেপ্টেম্বর একটি নৌকাডুবিতে অন্তত ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল শিশু। তীর থেকে মাত্র এক হাজার ফুট দূরে নৌকাটি ডুবেছিল। মিয়ানমার থেকে প্রায় ৮০জন রোহিঙ্গা নর–নারীকে বাংলাদেশ নিয়ে আসছিল নৌকাটি। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা গত ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করার পর থেকে এটা ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাবে ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
নুরুদ্দিন নামে এক মাঝি (পুরো নাম প্রকাশে যার আপত্তি আছে) রোহিঙ্গাদের আনার জন্য গভীর রাতে নৌকা নিয়ে মিয়ানমার যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
একদল মানুষকে নিয়ে প্রাণপনে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত একটি জেলে নৌকার দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে ৫৬ বছর বয়স্ক ওই জেলে বেনারকে বলেছেন, “সেখানে যেতে মাত্র দুই ঘন্টা লাগে।”
“এখন আর মাছ ধরতে ভালো লাগে না। মাছ ধরার চেয়ে মানুষ পারাপার করে এখন বেশি আয় করতে পারি,” তিনি বলেন।
রোহিঙ্গাদের পার করতে কত টাকা নেন— জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, “একেক সময় একেক রকম। কখনো তিন হাজার টাকা, কখনো চার হাজার টাকা, কখনো আরও বেশি। কত টাকা তাদের কাছে থাকে তার উপর এটা নির্ভর করে। তাদের কাছে যা থাকে, অনেকসময় সবটাই তারা দিয়ে দেয়।”
বেশি নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “তেলের খরচটাতো উঠাতে হবে। তা ছাড়া এ এক ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। এ পথে কত মানুষ মারা গেল!”
নুরুদ্দিন জানিয়েছেন, প্রথম দিকে তিনি প্রতিদিন দুটি করে খেপ দিয়েছেন। এক খেপে ২৫ থেকে ৪০ জন করে যেখান থেকে যাদের পেয়েছেন নৌকায় তুলেছেন।
“কিন্তু এখন পুলিশ খুব কড়াকড়ি করেছে। শরণার্থীদের নৌকায় নিয়ে আসতে নিষেধ করেছে। সেজন্যে বেশি রাতে যাই। সপ্তাহে দুই অথবা তিনবার,” তিনি বলেন।
নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশ আসতে আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৯০ জন মারা গেছে। ফলে রোহিঙ্গা পারাপারকারী জেলে নৌকার মাঝিদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। বঙ্গোপসাগরের বুকে শাহপরীর দ্বীপের ঠিক পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে নাফ নদী।
গ্রেপ্তার ৪৫০, নৌকা ধ্বংস ১৫৫টি: পুলিশ
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মইনুদ্দিন খান বেনার নিউজকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পাড়ে নিয়ে আসার দায়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ জন মাঝিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৫৫ টি নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে।
“তা সত্ত্বেও কিছু মানুষ এখনো রোহিঙ্গাদের নৌকায় করে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। আমরা তাদের শিগগিরই খুঁজে বের করব এবং গ্রেপ্তার করব,” তিনি বলেন।
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মোহাম্মদ হারুন (৩৮) নামে এক জেলে বেনারকে বলেন, শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের আনতে তিনি প্রতিদিন অন্তত একটা করে খেপ দিতেন।
“পুলিশ ধরপাকড় শুরু করার পর থেকে আমি এই কাজ ছেড়ে দিয়েছি,” জানান হারুন। বেনারকে তিনি বলেন, “সর্বশেষ মাস খানেক আগে একবার গিয়েছিলাম। জন প্রতি ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা নিয়ে এক একটি খেপে ৩০/৪০ জনকে এপারে আনতাম। প্রায় মাস খানেক এই কাজ করেছি। কিন্তু এখন আর করি না।”
হারুনের সহকর্মী ও প্রতিবেশী নুরুল আমীন (৪০) বলেন, যতদিন নিরাপদে ফিরতে পারছি ততদিন এটা ছিল দ্রুত বেশি টাকা উপার্জন করার সহজ উপায়।”
“আমার নিজের নৌকা নাই। দৈনিক ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্যের নৌকা ভাড়া নিতাম। সেটি দিয়ে প্রতিদিন দুই থেকে তিনটা খেপ দিতে পারতাম। একেকবারে অনেক মানুষ মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসতাম। মোটামুটি একটা ভালো আয় করার জন্য আমি বেশি মানুষ নৌকায় তুলতাম,” নূরুল আমীন বেনারকে বলেন।
হারুন এবং আমীন উভয়েই বলেন, পুলিশ বাধা না দিলে তাঁরা আবারও রোহিঙ্গাদের নিয়ে জেলেনৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে প্রস্তুত।
আমীন বলেন, “তাঁরা ওই দেশে দুর্ভোগে আছেন। আর্মি ওঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, মেরে ফেলছে। ওঁদের সাহায্য করতে পারলে ভালো লাগে। এর মধ্যে যদি কিছু বাড়তি আয় করা যায়, তাহলে অন্যায় কী?”
রোহিঙ্গারা নিরুপায়
তবে বৃহস্পতিবার যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে এসেছেন তারা জেলেদের ওই বক্তব্য খণ্ডণ করেছেন।
“রোহিঙ্গাদের তোলার জন্য এখনও মিয়ানমার প্রান্তে প্রতি রাতে দুই থেকে তিনটা নৌকা অপেক্ষমান থাকে,” মোহাম্মদ হাসিম (৪০) নামে একজন রোহিঙ্গা কৃষক বেনারকে জানান। হাসিম তাঁর স্ত্রী, ৫ পুত্র এবং মাকে নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। গত ১০ দিনের মধ্যে এই নিয়ে তিনি দুই বার বাংলাদেশে আসলেন।
“দুই সপ্তাহ আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে আসে। তারা নির্বিচারে গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমার চাচাতো ভাইসহ অনেক মানুষ মারা গেছে। আমার বাবার বাহুতে দুইটি গুলি লেগেছে,” হাসিম বলেন।
গ্রামের কাছাকাছি একটা জঙ্গলে পরিবারের অন্যান্যদের লুকিয়ে রেখে ৮০ বছরের বৃদ্ধ বাবাকে পিঠে তুলে নিয়েছিলেন হাসিম। পাঁচ দিন হাঁটার পর নদীর তীরে পৌঁছালে বাংলাদেশের মাঝিরা ২০০০ টাকার বিনিময়ে তাঁকে ও তাঁর বাবাকে নৌকায় করে বাংলাদেশ নিয়ে আসতে রাজি হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তাঁর বাবা মারা গেছেন বলে জানান হাসিম।
“আমি এখানে তাঁকে দাফন করেছি। এরপর পরিবারের লোকজন নিয়ে আসার জন্য মিয়ানমার গিয়েছিলাম। পরিবারের একেকজন সদস্য পার করতে এবার আমাকে মাথাপিছু ৭০০০ টাকা দিতে হয়েছে।”
“এপারে আসার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে আছি এটা তারা জানে। এ কারণে তারা যতটা সম্ভব দরকষাকষির মাধ্যমে আদায় করে নেয়,” বেনারকে জানান ওই কৃষক।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।