মিয়ানমারের দেওয়া রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের তালিকায় বিস্তারিত নেই: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
2017.11.03
ঢাকা
মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে গত মাসে বাংলাদেশকে দেওয়া তালিকা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কথিত সদস্যদের বের করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
“মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আরসা সদস্যদের একটি তালিকা আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা তালিকাটি দেখেছি; এর মধ্যে পাঁচ’শর বেশি নাম আছে যাদের বলা হচ্ছে আরসা সদস্য,” মঙ্গলবার বেনারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
তিনি বলেন, “এই তালিকায় রয়েছে শুধু নাম। তাদের বাড়ি কোথায় ছিল, বাবার নাম কী, পেশা কী, উচ্চতা, বয়স বিস্তারিত কোনো কিছুই নেই সেখানে।”
“আমরা কোনো সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবো না। কিন্তু শুধু নাম দিয়ে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে থেকে এদের বের করা সম্ভব? এদের বের করতে আমাদের আরও তথ্য প্রয়োজন,” মন্ত্রী বলেন।
তবে তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকারের দেওয়া জঙ্গিদের তালিকা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বাংলাদেশ।
“আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। তারা দেখছে কোনো আরসা সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কি না,” বলেন মন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার থেকে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করছে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া ডেস্কের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান বেনারকে বলেন, “আমরা মিয়ানমারের দেয়া তালিকা গুরুত্বের সাথে নিয়েছি।”
“বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে তাদের সম্পর্কে আরো তথ্য চেয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
সন্ত্রাসের জন্য ভূমি ব্যবহৃত হতে দেবে না বাংলাদেশ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সরকার কোনও দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য তার ভূমি ব্যবহৃত হতে দেবে না, তা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর সে কারণেই আমরা মিয়ানমারকে যৌথ সামরিক অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল গত ২৩ অক্টোবর মিয়ানমার পৌঁছে। পরদিন মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লে. জেনারেল কিয়ো সোয়ের সঙ্গে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মিলিত হন।
২৪ অক্টোবর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আগে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রসচিব তার মিয়ানমার প্রতিপক্ষের সঙ্গে সিনিয়র অফিশিয়াল সভায় মিলিত হন। ওই সভায় মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া আরসা সদস্যদের একটি তালিকা বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হককে দেওয়া হয়।
ওই সকল আরসা সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে অনুরোধ করা হয়।
পরদিন ২৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি’র সঙ্গে দেখা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সু চিকে বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে না নিলে তাদের কেউ কেউ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে।
সু চি দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং বলেন তাঁর সরকার কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
তবে বাংলাদেশকে না জানিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হওয়া কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি বাদ দিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বিবৃতি প্রকাশ করায় এ সংক্রান্ত যৌথ বিবৃতিতে সই করেনি বাংলাদেশ ।
“যৌথ ইশতেহারের ১০ দফায় কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরে দেখলাম ওই অংশ বাদ দিয়ে তারা একতরফাভাবে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাই আমরা বিবৃতিতে সই করিনি,” গত সপ্তায় বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
গত ২৪ অগাস্ট মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে আরসার সদস্যরা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর একযোগে আক্রমণ করলে পরদিন বার্মার নিরাপত্তা বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে।
এই অভিযানের ফলে এ পর্যন্ত ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। শরণার্থীদের সঙ্গে কিছু আরসা সদস্যও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়।
মিয়ানমারের দেওয়া তালিকা নিয়ে সন্দেহ
কুতুপালং ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূর বেনারকে টেলিফোনে বলেন, বার্মার দেওয়া আরসার তালিকা নিয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।
“দেখুন, আরসা বা আলেকিন (আল-ইয়াকিন) মিয়ানমার বা বাংলাদেশ কারও জন্যই ভালো নয়। এই আরসার জন্যই আমাদের আজকে এই অবস্থা। আমি এখানে ২০০৭ সাল থেকে আছি। আমরা কোনো আরসা দেখিনি,” কুতুপালং ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূর বেনারকে বলেন।
তিনি বলেন, “মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সবাইকে সন্ত্রাসী বলতে চায়। আমরা কি সন্ত্রাসী? আমরা সন্ত্রাসী নই। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের দেশ মিয়ানমারে বসবাস করতে চাই। আমাদের ওপর জুলুম বন্ধ করুক, আমাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিক। আমরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, দেখুন মিয়ানমার বাংলাদেশকে আরসার সদস্যদের যে তালিকা দিয়েছে তা দিয়ে তারা বাংলাদেশের ওপর কূটনীতিক চাপ সৃষ্টির করতে চায়।
“আসলে রাখাইনে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চালাচ্ছে সেটি ঢাকতে তারা সন্ত্রাসের এই বর্ম ব্যবহার করছে। তারা সকল রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। আর বাংলাদেশকে এই অসম্পূর্ণ তালিকা দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে চাইছে যে আরসা একটি ভয়াবহ সংগঠন, তাদের সদস্যরা বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং বাংলাদেশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না,” বলেন ড. দেলোয়ার হোসেন।
ড. দেলোয়ার বলেন, “আরসার প্রধান আতাউল্লাহর সৌদি ও পাকিস্তানের জীবন ছাড়া আরসার কর্ম পদ্ধতি, সদস্য সংখ্যা বা অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য গ্রহণযোগ্য কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাচ্ছি না। পাঁচশ’র বেশি সশস্ত্র সদস্য থাকলে সেই সংগঠন নিঃসন্দেহে বিরাট আকারের। কিন্তু আমরা ২৪ আগস্টের পর আরসার কোনো কার্যক্রম দেখিনি।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উচিত হবে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।