ডাকাতি ও অপহরণ সম্পৃক্ততা সন্দেহে ৫ রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার
2017.11.06
কক্সবাজার
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সপ্তাহজুড়ে অভিযান চালিয়ে দেশীয় অস্ত্রসহ পাঁচ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কর্মকর্তারা।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাব কর্মকর্তা মেজর রুহুল আমিন বেনারকে বলেন, “ধৃত ব্যক্তিরা উখিয়ার শরাণার্থী শিবিরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে ডাকাতি ও অপহরণের মতো অপরাধে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।”
সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তি সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা বলে জানিয়েছেন মেজর আমিন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে সম্প্রতি নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হলে সেখানকার অন্তত ৬ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
“আমরা তাদের কাছ থেকে পাঁচটি রাম দা উদ্ধার করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বেশ কয়েকটি ডাকাতি এবং অপহরণের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল,” মেজর আমিন বলেন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন: আবু বক্কর সিদ্দিকী (২০), মোহাম্মদ আনোয়ার (২০), মোহাম্মদ ফারুক (২২), এমরান (২২) এবং খায়ের মোহাম্মদ (২০)।
এসব সন্দেহভাজন অপরাধী উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ডেরা গেড়েছে বলে তিনি জানান।
গত মাসে ইলিয়াস (২৫) এবং নূরুর বাশার (২৬) নামে দুজন রোহিঙ্গা শরণার্থী গুলি ও বন্দুকসহ গ্রেপ্তার হওয়ার প্রেক্ষিতে র্যাব সপ্তাহব্যাপি এই অভিযান শুরু করে। রবিবার অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। প্রায় ৫০ জন র্যাব সদস্য এই অভিযানে অংশ নেন বলে জানান মেজর আমিন।
“আমরা আপাতত অভিযান শেষ করেছি। তবে আমরা বুঝতে পারছি শরণার্থী শিবিরগুলোতে আরও অস্ত্র লুকিয়ে রাখার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তাই নজরাদারীর জন্য আমরা সাদা পোশাকে নজরদারি বজায় রেখেছি,” তিনি জানান।
তিনি বলেন, যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের সঙ্গে আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মির (আরসা) সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, আরসা মিয়ানমারের রাখাইনভিত্তিক একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন।
আরসা সদস্যরা মিয়ানমারের কয়েকটি পুলিশ ও সেনা শিবিরে আক্রমণ চালানোর পর গত ২৫ আগস্ট থেকে প্রতিশোধমূলক অভিযানে নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
“তারা (সন্দেহভাজনেরা) কয়েকটি ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি ৭ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে চাঁদা আদায়ের ঘটনার সঙ্গেও তারা জড়িত। শরণার্থী রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে তারা একেকটি ঘটনায় মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করেছিল,” তিনি জানান।
“যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে গরু–ছাগল এবং স্বর্ণ নিয়ে এসেছে এবং যাদের আত্মীয়–স্বজন বিদেশে আছে তাদেরকেই এরা অপহরণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে,” আমিন জানান।
“শুরুর দিকে অসংখ্য রোহিঙ্গা একসাথে বাংলাদেশে এসেছে। তাদের সবাইকে তল্লাশী করা সম্ভব হয়নি। ফলে তাদের কেউ কেউ সঙ্গে করে অস্ত্র নিয়ে আসা অসম্ভব নয়,” আমিন বলেন।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের মিয়ানমার সফরকালে দেশটির সরকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা পাঁচশো জনের বেশি আরসা সদস্যের একটি তালিকা বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে গত সপ্তায় এক সাক্ষাৎকারে বেনারকে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে “এ ধরনের তালিকা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। ওটি আমাদেরকে পাঠানো হয়নি,” বলে মন্তব্য করেন মেজর আমিন।
স্থানীয় পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত দুই মাসে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনেকখানি বেড়ে গেছে। এসব এলাকায় অন্তত ১৫ টি শরণার্থী শিবির রয়েছে।
“সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর আশেপাশে প্রায় ১০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। হত্যা, হামলা, ডাকাতি এবং মাদক চোরাচালানের অভিযোগে এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার এক পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে বলেছেন।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রধান মাইনুদ্দিন খান জানান, শুধু তাঁর এলাকাতেই ১০ জন রোহিঙ্গাকে ডাকাতি, হত্যা এবং মাদক পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
“আমরা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নজরদারি করছি। অপরাধীরা যাতে এই বড় সংকটের সুযোগ নিয়ে বেআইনী কাজে লিপ্ত হতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত তল্লাশী চালানো হয়,” বেনারকে বলেন ওসি মাইনুদ্দিন।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে কিছু সংখ্যক অপরাধী থাকবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
তিনি বলেন, “ভাসমান এই সম্প্রদায়ের জন্য সাহায্যের আবশ্যকতা বাংলাদেশ মেনে নিলেও এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, এই ব্যাপক অনুপ্রবেশ এ দেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করেছে।”
“এখন এই শরণার্থী অনুপ্রবেশের স্রোত বন্ধ হওয়া এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই,” বলেন তিনি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন করল যুক্তরাষ্ট্র
গত রোববার ষষ্ঠ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় অনুষ্ঠিত অংশীদারত্ব সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি থমাস শ্যানন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দেন।
সংলাপ শেষে যৌথ সাংবাদ সম্মেলনে শ্যানন বলেন, “উত্তর রাখাইনে সংগঠিত নৃশংসতার মাত্রা নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স এবং সেক্রেটারি টিলারসনসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্বেগ পুনরায় ব্যক্ত করেছি। এ ছাড়া ২৫শে আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রতি উদারতা দেখানোর জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেন, “আমরা রাখাইন রাজ্যের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছি।”
প্রসঙ্গত, এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জেনারেলদের দায়ী করেন।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান ও ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।