রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: কূটনৈতিক পথেই বাংলাদেশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.11.16
ঢাকা
প্লাস্টিকের জারিকেন দিয়ে তৈরি ভেলায় টেকনাফের কাছে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। প্লাস্টিকের জারিকেন দিয়ে তৈরি ভেলায় টেকনাফের কাছে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ১০ নভেম্বর ২০১৭।
REUTERS

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রী পর্যায়ে তৃতীয় দফা আলোচনার জন্য আগামী রোববার মিয়ানমার সফর করবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে মিয়ানমার সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান বন্ধ ও সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানানোর পরপরই সবাইকে ফিরিয়ে নেওয়া ‘অসম্ভব’ বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী এশিয়া ও ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিতে ১৯ নভেম্বর মিয়ানমার যাত্রা করবেন। বৈঠকটি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। এর পরেই অনুষ্ঠিত হবে মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে জানান, নভেম্বরের ২২-২৩ তারিখ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ের সাথে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।

“নভেম্বরের ২২-২৩ তারিখে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে আমরা বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) জন্য একটি ‘স্থিতিশীল’ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেবো, যাতে তাঁরা আবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য না হয়,” বেনারকে বলেন মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী।

মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার আয়োজন সম্পর্কিত বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হবে এবং পরবর্তীতে ওই বৈঠকের সিন্ধান্তের আলোকে দুই পক্ষ প্রত্যাবাসন কার্যক্রম যাচাই বাছাইর জন্য জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করবে বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।

“সেখানে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা) ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে তা নির্ভর করছে দুই পক্ষের ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর ওপর,” বলেন মঞ্জুরুল করিম।

মিয়ানমার-বাংলাদেশ ভিন্নমত

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দিক থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে কয়েকটি ভিন্নমত আছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা চাই সমঝোতা চুক্তিতে (টিওআর) ‘কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন’ কথাটা রাখতে। কিন্তু মিয়ানমার সেখানে ‘বাস্তবায়ন’ কথাটা রাখতে রাজি নয়।”

প্রসঙ্গত কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সম অধিকার দেবার সুপারিশ করা হয়েছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশ চায় বাস্তুচ্যুত লোকজনকে রাখাইন রাজ্যে তাঁদের মূল ঠিকানাতেই পুনর্বাসিত করা হোক, কিন্তু মিয়ানমার তাঁদেরকে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে চায় বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

“তাঁদেরকে যদি মূল ঠিকানায় যেতে দেওয়া না হয়, তাহলে তাঁরা মিয়ানমার ফিরে যেতে রাজি হবে না। রোহিঙ্গারা মনে করে রাখাইন রাজ্যের আশ্রয় শিবিরগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকা অনেক ভালো,” বলেন তিনি।

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতে চায়, কিন্তু মিয়ানমার চায় ওটা দ্বিপাক্ষিকভাবে করতে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে গত ২৩ অক্টোবর নেপিদোতে মিয়ানমারের সাথে মন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিতীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বৈঠক শেষে তিনি বেনারকে জানিয়েছিলেন, কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরে ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে একমত হয়েছিল মিয়ানমার।

কিন্তু পরবর্তীতে এক তরফাভাবে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের বিষয়টি বাদ দিয়ে মিয়ানমার ওই বৈঠকের বিবৃতি প্রকাশ করায় বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে।

এর আগে অক্টোবর মাসের ২ তারিখ মিয়ানমারের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ের ঢাকা সফরের সময় মন্ত্রী পর্যায়ের প্রথম বৈঠকে তাঁর কাছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে একটি চুক্তির খসড়া হস্তান্তর করেন।

আগস্টের ২৪ তারিখ মিয়ানমাররে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী একযোগে হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান পরিচালনা করে, যাকে জাতিসংঘ ‘জাতিগত নির্মূলের আদর্শ উদাহরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই নিপীড়ন ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সংস্থাগুলোর জোট আইএসসিজি।

উখিয়ার বালুখালি শরণার্থী শিবিরের পথে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের স্রোত। ২ নভেম্বর ২০১৭।
উখিয়ার বালুখালি শরণার্থী শিবিরের পথে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের স্রোত। ২ নভেম্বর ২০১৭।
AFP

স্বাধীন তদন্তের আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের

মিয়ানমার সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের ঘটনার স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চালানো প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন।

বুধবার মিয়ানমারে রাজাধানী নেপিদোতে দেশটির নেত্রী আং সান সুচির সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই আহ্বান জানান।

সংবাদ সম্মেলনের আগে তিনি মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।

তিনি বলেন, “আমার মতে, রাখাইনে যা ঘটেছে বলে আমরা জানি, যার ফলে অসংখ্য মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে, এতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের নিশ্চিত বহু উপাদান রয়েছে।”

“আমি মনে করি, এই কারণেই বিষয়টা সম্পর্কে জানতে সহায়তার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত খুবই সহায়ক হবে, এটা শুধু ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে নয়, বরং যা ঘটেছে তার পেছেন উদ্দেশ্য কী ছিল, তা জানতেও,” বলেন তিনি।

সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য টিলারসন মিয়ানমারকে ৪ কোটি ৭ লক্ষ ডলার অর্থ দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন।

সবাইকে ফেরত নেওয়া অসম্ভব: মিয়ানমারের সেনাপ্রধান

এদিকে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের প্রতি ‘সব শরণার্থী’ ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানোর পরপরই এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন মিয়ানমারের ‘আসল নাগরিকদের’ কাছে গ্রহণযোগ্যতার ওপর নির্ভর করবে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন দেশটির সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইয়াং।

সব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া ‘অসম্ভব’ বলেও বিবৃতিতে মন্তব্য করেন তিনি।

বুধবার মিয়ানমারের সেনাপ্রধান নিজের ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে বলেন, “রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় বাসিন্দা, যারা মিয়ানমারের আসল নাগরিক, তাঁদের ইচ্ছার ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে যখন বিষয়টা গ্রহণযোগ্য হবে, একমাত্র তখনই তা সবার জন্য সন্তোষজনক হবে।”

একই সাথে বাংলাদেশ বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের পরিবারসহ পালিয়ে যাওয়া ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে সবাইকে নেওয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ যত লোকের প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে একমত হওয়া অসম্ভব।”

রোহিঙ্গাদের দেখতে যাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা

বিভিন্ন দেশের তিনজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধি আগামী রোববার একদিনের সফরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন বলে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা হলেন, জার্মানির সিগমার গেব্রিয়েল, সুইডেনের মারগোট ওয়ালস্ট্রম, জাপানের তারো কোনো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি ফেডেরিকা মগেরিনি।

শরণার্থী শিবির পরিদর্শনকালে তাঁরা কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিদর্শন ও রোহিঙ্গাদের সাথে আলাপ করবেন বলেও বিজ্ঞিপ্তিতে জানানো হয়।

তাঁদের সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও থাকবেন বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।