তীরে ভিড়তে না দিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা সাগরে ফিরিয়ে দিলেন ইন্দোনেশিয়ার গ্রামবাসী

চলতি সপ্তায় সাগরপথে ইন্দোনেশিয়া পৌঁছানো প্রায় ৬০০ রোহিঙ্গার মধ্যে দুই শতাধিক শরণার্থীবাহী একটি নৌকাকে তীরে ভিড়তে দেয়নি গ্রামবাসীরা।

গত সোম এবং মঙ্গলবার দুটি পৃথক নৌকায় অন্তত ৪০০ উদ্বাস্তু ইন্দোনেশিয়ার আচেহ পৌঁছান। আচেহ পুলিশ এবং স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন, শরণার্থীদের আগের দুটি দলকে খাবার, জল, চিকিৎসা সেবা এবং অস্থায়ী আশ্রয় দেয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সর্বশেষ নৌকাটি ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে পৌঁছালে স্থানীয়রা এই তৃতীয় দলটিকে সমুদ্রে ফিরে যেতে বাধ্য করে।

প্রথম এক জায়গায় বাধার সম্মুখীন হয়ে ফিরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় আরেক স্থানে গিয়ে নৌকাটি ভিড়লে সেখানেও শরণার্থীরা একই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, কয়েক বছর ধরে উদ্বাস্তুদের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার উদারতার অপব্যবহার করে আসছে পাচারকারীরা। উদ্বাস্তুরা স্থানীয়দের জন্য সমস্যা তৈরি করছে।

বিরুয়েন পুলিশের মুখপাত্র মারজুকি বলেছেন, বেশ কয়েকদিন ধরে ভেসে যাওয়া কাঠের নৌকাটি প্রথমে বিরুয়েন জেলার উপকূলে দেখা গিয়েছিল। সেখানে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী উদ্বাস্তুদের মানবিক কারণে অবতরণ করতে গ্রামবাসীদের রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল।

“কিন্তু গ্রামবাসীরা মানেনি। কারণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে তাঁদের আগের অভিজ্ঞতা খারাপ। তাঁরা বলছেন, উদ্বাস্তুরা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গিয়ে জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে," বেনারকে বলেন মারজুকি।

তিনি বলেন, “আমরা আলোচনা করেছি, কিন্তু স্থানীয়রা তাদের মেনে নিতে রাজী হয়নি।”

স্থানীয় পুলিশের মুখপাত্র সালমান আলফারিসি জানান, “নৌকাটি তারপরে ফিরে যায় এবং উত্তর আচেহের লোকসুমাওয়েতে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও তারা স্থানীয়দের কাছ থেকে একই রকম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়।”

“তারা আবার যাত্রা করতে যাচ্ছিল কিন্তু তাদের নৌকার ইঞ্জিনে সমস্যা ছিল,” বলেন তিনি।

বিরুয়েন পুলিশের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জলি রনি মামারিমিং বলেছেন, কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের খাবার ও পানীয় সরবরাহ করেছে এবং তাঁদের মধ্যে খারাপ অবস্থায় থাকা পাঁচজনকে নামতে দিয়েছে।

পুলিশের শেয়ার করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে নৌকাটিকে তীর থেকে ২০০ মিটারের (৬৫৬ ফুট) মধ্যে দড়ি দিয়ে উপসাগরে আটকে রাখা হয়েছে।

স্থানীয় জেলেদের মতে, নৌকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে সেখানে গেছেন। বৃহস্পতিবার তীর থেকে ফিরিয়ে দেয়া নৌকার এক শরণার্থী বার্তাসংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, যে ওই নৌকার যাত্রীরা কক্সবাজার থেকে রওয়ানা দিয়েছিলেন।

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বর্তমানে দশলাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। যাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ এসেছেন ২০১৭ সালে আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিপীড়নমূলক অভিযান থেকে বাঁচতে।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা কয়েক দশক ধরে নিয়মতান্ত্রিক বৈষম্য, রাষ্ট্রহীনতা এবং সহিংসতার সম্মুখীন হয়ে আসছেন।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, রোহিঙ্গাদের পলায়ন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের অবনতিশীলতা এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরের ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরেছে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, অনেক রোহিঙ্গা মরিয়া হয়ে উঠেছেন, কারণ তাঁরা সামরিক অভ্যুত্থানের পর সহিংসতায় বিপর্যস্ত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের কোনো আশা দেখতে পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও কাজ করার সুযোগ এবং সন্তানদের সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্যমতে, গত বছর সমুদ্রপথে যাত্রা করে অন্তত ৩৪৮ জন রোহিঙ্গা নিখোঁজ হয়েছেন।

ID-pic-2.jpg
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের বিরুয়েন জেলায় স্থানীয়রা রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাকে তীরে ভিড়তে না দেবার পর নৌকার মধ্যে রোহিঙ্গারা। ১৬ নভেম্বর ২০২৩। [এএফপি] (AMANDA JUFRIAN/AFP)

সহায়তা দিতে প্রস্তুত ইউএনএইচসিআর

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে উদ্বাস্তুদের জন্য সীমান্ত খোলা রাখা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ায় ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র মিত্রা সালিমা বেনারকে বলেন, “ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের জীবন বাঁচাতে সরকার, কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় মানুষকে সহায়তা করতে প্রস্তুত।”

“তবে আমরা আশা করি তারা এখনও সহায়তা দেবে। তারা বিবেচনা করবে শরণার্থীদের মধ্যে অনেক দুর্বল নারী ও শিশু রয়েছেন,” যোগ করেন তিনি।

বিশ্বের সবচেয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর ইতিহাস রয়েছে।

২০১৫ সালে বাংলাদেশী অভিবাসীসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা কয়েক মাস ধরে সমুদ্রে আটকে থাকার পর ইন্দোনেশিয়া পৌঁছালে দেশটি তাঁদের তীরে নামতে দিয়েছিল।

ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লালু মুহাম্মদ ইকবাল বলেছেন, ইন্দোনেশিয়া ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ না হওয়ায় উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। এটা কোনো স্থায়ী সমাধানও নয় বলে তিনি মনে করেন।

বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “অদ্ভুত বিষয় হল, কনভেনশনে স্বাক্ষর করা অনেক দেশ আছে, যারা শরণার্থীদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি শরণার্থীদের বিরুদ্ধে পুশব্যাক নীতিও বাস্তবায়ন করেছে।”

“অস্থায়ী আশ্রয় প্রদানে ইন্দোনেশিয়ার উদারতার সুযোগ নিচ্ছে মানব পাচারকারীরা। তারা আর্থিক লাভের জন্য উদ্বাস্তুদের উচ্চ ঝুঁকি, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মতো দুর্বল গোষ্ঠীর বিপদের কথা ভাবছে না," বলেন তিনি।

ইন্দোনেশিয়া শরণার্থীদের আশ্রয় বা আইনি মর্যাদা দেয় না।

ইন্দোনেশিয়ায় আসা শরণার্থীরা সাধারণত অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে বা আটক কেন্দ্রে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন, কারণ সেখানে তাঁদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ নেই।