রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস
2021.11.18
ঢাকা

প্রথমবারের মতো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে জাতিসংঘে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার “রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে,” বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
এই প্রস্তাবনাকে বাংলাদেশের জন্য “একটি বিরাট সুখবর” দাবি করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “এর ফলে রোহিঙ্গা ফেরাতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।”
তিনি বলেন, “জাতিসংঘে এই প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে। রাশিয়া-চীন আগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাধা দিত। তবে তারা এবার চুপ ছিল। তারাও এই সমস্যা দূর করতে চায়।”
“রাশিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, চীনের সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। সব দেশই রোহিঙ্গা ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি শীর্ষক এই প্রস্তাবনাটি বুধবার সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে (সোশ্যাল, হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড কালচারাল) যৌথভাবে উত্থাপন করে ওআইসি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে জাতিসংঘ। গৃহীত প্রস্তাবে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট অবসানের আহ্বান জানানো হয়।
প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা, বাংলাদেশের সঙ্গে সই হওয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করা এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ জাতিসংঘের সব মানবাধিকার ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
প্রস্তাব অনুমোদনের সময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন।”
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “প্রস্তাবনায় প্রাথমিকভাবে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং জরুরি অবস্থা জারির পরের পরিস্থিতি।”
“থার্ড কমিটির অনুমোদন পাওয়া প্রস্তাবে মিয়ানমারের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখাতে দেশটির নিরাপত্তা ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাতে সাধারণ পরিষদকে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তর, আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং জরুরি অবস্থার অবসানের আহ্বান জানানোর কথা বলা হয়েছে,” বলা হয় জাতিসংঘের বিবৃতিতে।
নৈতিক চাপ
জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবটির “কোনো ব্যবহারিক ভূমিকা” না থাকলেও “আন্তর্জাতিক জনমতের প্রতিফলন” হিসেবে এর গুরুত্ব রয়েছে বলে বেনারকে জানান জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, “এটা বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো যে, নৈতিক অবস্থান থেকে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া গেলো। কিন্তু ব্যাবহারিক উপযোগিতা পেতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব দরকার।”
সাধারণ পরিষদের এধরনের প্রস্তাবনা নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত পেতে উপযোগী হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তা নয়। নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্তগুলো হয় ভিন্ন আঙ্গিকে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদের মতে করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কিছুকাল নীরবতা তৈরি হলেও “জাতিসংঘের এই প্রস্তাবনা মিয়ানমারকে বুঝিয়ে দিলো যে বিশ্ব সম্প্রদায় বিষয়টি কোনোভাবে ভুলে যাবে না।”
মিয়ানমারের জন্য প্রস্তাবনাটিকে “একটি চাপ” হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বেনারকে বলেন, এই প্রস্তাবের একটি ভালো দিক হলো, “চীন এবং রাশিয়াও এবার এই রেজুলেশনে বাধা দেয়নি।”
তবে তাঁর মতে, “বাংলাদেশ যেন এটা পেয়েই সন্তুষ্ট না থাকে। এজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে যেসব দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে, বিশেষত ভারত এবং জাপানের সুদৃঢ় সমর্থন নেওয়ার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ আরও জোরালো করতে হবে।”
“তারা মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা করুক, কিন্তু রোহিঙ্গা নিয়ে তাদের যেন সবসময় একটি আলাদা অবস্থান থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার। কারণ, চীন মিয়ানমারের পুরাতন মিত্র হলেও এই দুটি দেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক অতটা নয়,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ।
এবারের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১০৭ দেশ সমর্থন দিয়েছে, যা ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
২০১৭ সালের আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে মিয়ানমার ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে জাতিসংঘ কমিটিতে বাংলাদেশের দূত রাবাব ফাতিমা বলেন, “প্রত্যাবাসনের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের হতাশা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে যা এ অঞ্চলে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।”
“আশা করা যায় এবারের প্রস্তাবনাটি নিজভূমি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে,” বলেন তিনি।