সীমান্তে কড়া নজরদারি তবুও অনুপ্রবেশ ঘটছে রোহিঙ্গাদের
2016.11.21
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সেনা অভিযানে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের সীমান্ত উন্মুক্ত করে আশ্রয় দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ অনুরোধ জানালেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ। বিষয়টি শুধু পর্যবেক্ষণে রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
দুঃখ দুর্দশার মুখে পড়া শত শত রোহিঙ্গা প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সীমান্তে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এমন অবস্থায় আরও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সহিংসতা কমাতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগসহ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অন্যান্য দেশকেও এগিয়ে আসতে জাতিসংঘের মাধ্যমে আহ্বান জানানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে টেকনাফ সীমান্তের ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বেনারকে বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা রয়েছে—বাংলাদেশে কোনো অবৈধ অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। আগেও এ নির্দেশনা ছিল, এখনো আছে। সেভাবেই আমরা কাজ করছি। সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছি।”
তবে নিজেদের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের অনুরোধের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে করা হচ্ছে জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুটি সরকারের পর্যবেক্ষণে আছে। জাতিসংঘ তো অনেক কিছু বলে, তবে আমাদেরকে প্রথমে নিজেদের স্বার্থ দেখতে হবে।”
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযানে রোহিঙ্গা নির্যাতনের পাশাপাশি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ‘পুশব্যাক’ করার খবরও গুরুত্ব পেয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তবে এ বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বেনারকে বলেন, “পুশব্যাক মানে কাউকে ধরে তারপর আবার ফেরত পাঠানো। কিন্তু আমরা আসলে কাউকে প্রবেশই করতে দিচ্ছি না। সুতরাং ‘পুশব্যাক’ কথাটি সঠিক নয়।”
সীমান্তে নজরদারির বিষয়ে তিনি বলেন, “মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আগেও ছিল, এখনো আছে। সেটা রুখতে আমরা সীমান্তে বিশেষ করে নাফ নদীতে নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করলে, আমাদের জোয়ানরা তাদের দেশে ফেরত যেতে অনুরোধ করেন। তাদের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করা হয় না।”
এ পর্যন্ত কত জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, সে সংখ্যা জানা নেই উল্লেখ করে এই বিজিবি অধিনায়ক বলেন, “বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে রোহিঙ্গারা ঢোকার চেষ্টা করে। আমরা সব সময় চেষ্টা করি তাদের ফেরত পাঠাতে।”
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। এ প্রসঙ্গে লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, “পৃথিবীর কোনো সীমান্তেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হয় না। তো এক-দুজন যদি কোনো এলাকা দিয়ে ঢুকে যেতে পারে, সেটাকে আমরা সংগঠিত অনুপ্রবেশ বলতে পারি না।”
নিরাপত্তা হুমকির মুখে
মূলত দেশের নিরাপত্তা হুমকির কারণেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, “আমরা (বাংলাদেশ) তো তিন লাখ বা আরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। সেখানে (রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে) জঙ্গিবাদ ও জামায়াত নানা অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশি কিছু এনজিও কাজ করছে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিষয়টি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘের মাধ্যমে যাতে এসব রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দেওয়া হয় তার উদ্যোগ নেওয়া।” “জাতিসংঘ অন্য দেশকে না বলে কেন শুধু বাংলাদেশের ওপরই রোহিঙ্গাদের চাপানোর চেষ্টা করছে?"—এই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
তবে বিষয়টি মানবিকভাবে দেখার পক্ষে মত দিয়েছেন শরণার্থী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করার আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ শরণার্থী বিষয়ক কনভেনশনে স্বাক্ষর না করলেও বিশ্ব মানবাধিকার সনদ, টর্চার কনভেনশন, শিশু সনদসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। সে অনুযায়ী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রাখে। এটা আইনগত একটা দিক। সেটা অবশ্যই বাংলাদেশকে অক্ষুণ্ন রাখা উচিত।
নৈতিক দিকের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাঁরা (রোহিঙ্গা) তো স্বেচ্ছায় আসছে না। বাধ্য হয়ে জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে আশ্রয় পাওয়ার জন্য আসছে। এমন অবস্থায় আমাদের দরজা বন্ধ করে দেওয়া সমুচিত নয়। সংবিধানেও আন্তর্জাতিক সনদ মেনে চলার কথা বলা হয়েছে।”
এক মাসে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা অবকাঠামো ধ্বংস
এদিকে মিয়ানমারে গত এক মাসে রোহিঙ্গাদের এক হাজারেরও বেশি বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। শিগগিরই এ সব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানাতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ করে সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, গত ১০-১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সহিংসতায় রাখাইন রাজ্যের মংগদাউ জেলার কয়েকটি গ্রামে আটশো ২০টি ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এর আগে গত ২২ অক্টোবর-১০ নভেম্বর পর্যন্ত একই জেলায় চার শ ৩০টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই নিয়ে এক হাজার দু শ ৫০টি ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।
এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, “রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ধ্বংসের যে চিত্র দেখা গেছে, তা মিয়ানমার সরকারের দেওয়া তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি এবং আরও ভয়াবহ। জাতিসংঘের অংশগ্রহণে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে মিয়ানমারকে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।”