রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে ঢাকার উদ্বেগ, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব
2016.11.23
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে সৃষ্ট অমানবিক পরিস্থিতিতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সেখানে সহিংসতা বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এদিকে সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। তবে ধরা পড়লেই তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দুদেশের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসলেও গতকাল বুধবার সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়। তবে শুরু থেকে অস্বীকার করে আসলেও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা ওই বৈঠকে স্বীকার করেন যে, নিরীহ মুসলিম রোহিঙ্গারা গৃহহীন হয়ে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলসহ দেশের মানবাধিকার কর্মীরাও মানবিক কারণে অসহায়দের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন।
তবে সরকার মনে করছে, আন্তর্জাতিক মহলসহ অন্যান্যরা মিয়ানমারের পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশের ওপরই চাপ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে, আরো অনু্প্রবেশ ঘটলে সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকার কড়া প্রতিবাদ
বুধবার দুপুরে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে উদ্বেগ জানিয়ে একটি কূটনৈতিক পত্র তুলে দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয় ও কনস্যুলার) কামরুল আহসান।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর চলা দমন-পীড়নের যে পরিস্থিতি চলছে তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। অবিলম্বে এ নিপীড়ন বন্ধ করে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।”
পরে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবকিছুই করছে। সংশ্লিষ্ট দেশটির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চালানো হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “এ সমস্যার উৎস মিয়ানমার। সুতরাং আমরা সেখান থেকেই এর সমাধান চেয়েছি।”
রাষ্ট্রদূতকে তলবের পর এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে মিয়ানমারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়।
এতে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের সময় নির্বিচারে হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্তের যে দাবি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানিয়েছে, তাতে সাড়া দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৯ অক্টোবর দেশটির রাখাইন রাজ্যের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলা চালালে দেশটির নয়জন সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর হয়। এরপর থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী।
এর ফলে সৃষ্ট সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৮৬ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে মিয়ানমার। যাদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে দাবি করেছে দেশটি। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে দাবি করেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী ২৩ ও ২৪ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করেছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছে। কারণ, এই মুহূর্তে আলোচনা করার মতো কোনো পরিবেশ নেই।”
ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে পুনরায় দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের সময় শতাধিক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের) সদস্যরা।
অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য বিজিবি ও কোস্টগার্ড নারী ও শিশুসহ ৭০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে।
তবে স্থানীরা বলছেন, ইতোমধ্যে সীমান্তরক্ষীদের নজর এড়িয়ে শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং স্থানীয় রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গেই বসবাস করছে। এ ছাড়াও শ’খানেক মিয়ানমার নাগরিক দুদেশকে বিভক্তকারী নাফ নদীতে ভেসে এদেশে প্রবেশের অপেক্ষা করছে।
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বেনারকে বলেছেন, “রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে।”
তবে জীবনের ভয়ে ভীত এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে শরনার্থীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন রামরু'র নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার বেনারকে বলেন, “মানবিক দিক বিবেচনা করে স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হবে। আরো খোলা মন নিয়ে দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে আচরণ করতে হবে। কারণ, তারা অর্থনৈতিক অভিবাসী নয়, তারা জীবনের ভয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থী।”
তবে সাধারণ রোহিঙ্গার সঙ্গে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আরেক মানবাধিকার কর্মী, আইন ও শালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান।
তিনি বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের এই মানবিক বিপর্যয়ে আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। তবে যথাযথ সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।”
অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সহায়তা করবে মিয়ানমার
বুধবার কক্সবাজারে বিজিবি ও মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি’র আঞ্চলিক কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে সেনা অভিযানে রাখাইনের নিরীহ মুসলিম রোহিঙ্গারা গৃহহারা হচ্ছে বলে স্বীকার করে বিজিপি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তারা সহায়তা করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেয়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বৈঠক শেষে বিজিবি দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের (চট্টগ্রাম) কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার ফরিদ হাসান সাংবাদিকদের জানান, মূলতঃ বিজিপির নতুন আঞ্চলিক কমান্ডারের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত পরিচিতিমূলক বৈঠক হলেও বৈঠকে সীমান্ত এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বলে জানানো হলে বিষয়টি তাদের টিম লিডার স্বীকার করে নেন। রোহিঙ্গারা যাতে না আসতে পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।”
জেনারেল খন্দকার ফরিদ হাসান আরো বলেন, অনুপ্রবেশ ও যেকোনো অপরাধ দমনে তথ্য আদান-প্রদান ও যৌথ টহলের বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।