রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি: আশাবাদী নন শরণার্থীরা
2017.11.27
ঢাকা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত নতুন দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে নাগরিকত্ব এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকায় দেশে ফেরার আগ্রহ দেখাচ্ছে না বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। অন্যদিকে মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ীই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে মনে করেছেন বিশ্লেষকেরা।
দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২০১৬ অক্টোবর ও তার পরে আসা নাগরিকদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। দেশটি সফরে গিয়ে এ বিষয়ে একটি সম্মতিপত্র সই করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
দেশে ফিরে গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ১৯৯২ সালের চুক্তির অনুসরণে এবারের চুক্তিটি হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের অক্টোবর এবং এ বছরের ২৫ আগস্টের পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তাদেরই শুধু ফেরত নেবে মিয়ানমার।
বেনারনিউজ এই চুক্তির একটি অনুলিপি পেয়েছে যাতে এসব শরণার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’র পরিবর্তে ‘রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর সেনা অভিযানের মুখে প্রায় ৮৫ হাজার আর চলতি বছরের ২৫ আগস্টের পর আরও সোয়া ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগেও এ দেশে আশ্রয় নেয় চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
১৯৯২ সালে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় এক চুক্তির আওতায় কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিলেও পরে আর সাড়া দেয়নি মিয়ানমার।
নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা চায় রোহিঙ্গারা
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূর বেনার নিউজকে জানান, তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ফেরত পাঠানোর চুক্তি সম্পর্কে মিডিয়া থেকে জানতে পেরেছেন।
“আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেই আমরা আমাদের স্বদেশ আরাকানে ফিরে যেতে চাই। মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতির মতো রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং আমাদের নাগরিকত্ব অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে।”
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও রাখাইনরা আবার তাদের নির্যাতন করার চেষ্টা করবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “আরাকানে আমাদের অবাধে চলাফেরা করার অনুমতি দিতে হবে। সেখানে কি কোনো গ্যারান্টি আছে যে, তারা আবার আমাদের মেরে ফেলবে না বা নির্যাতন করবে না? বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, আমাদের ওপর আর কোনো আক্রমণ হবে না।”
ঢাকায় দেখা মেলে মোহাম্মদ সালাম নামে এক রোহিঙ্গার সঙ্গে, যিনি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছেন বলে জানান। বছর ষাটেক বয়সের এই লোকটি ১৯৯৪ সালে পুনর্বাসিত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের একজন।
তিনি বেনারকে বলেন, “তারা (মিয়ানমার) আমাদের ফিরে নেওয়ার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। আমরা আরাকানে ফিরেও গিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করেনি, তাদের আক্রমণ ও নির্যাতন দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যদি ফিরে যাই তবে আর্মি ও মগেরা আমাদের আবার তাড়িয়ে দেবে।”
এই চুক্তি প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করবে না
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৯২ সালের চুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল।
তিনি বেনারকে বলেন, গত ২৩ নভেম্বর দু’দেশের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে, তা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করবে না।”
তিনি বলেন, “মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ীই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে না। তাই আমি মনে করি কোনো রোহিঙ্গা ফিরে যাবে না।”
কেবলমাত্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে বলে মনে করেন সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব।
“বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিকভাবে এই সমস্যা সমাধানে সম্মত হয়ে বড় ভুল করেছে,” মন্তব্য করে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “চুক্তিতে মিয়ানমারের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে, বাংলাদেশের নয়।”
মোস্তাফা কামালের মতোই দ্বিপক্ষীয়ভাবে এই সমস্যার সমাধানে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবীর।
তিনি বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা না দেওয়া হয়, তবে তারা ফিরে যাবে না।”
দু’মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
তবে এই প্রক্রিয়া কবে নাগাদ শেষ করা হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময় চুক্তিতে নির্ধারিত হয়নি জানিয়ে ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে’ দুই পক্ষ প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে সম্মত হয়েছে বলে জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, “আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন এবং ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ চূড়ান্ত করা হবে। দু’দেশের মধ্যে হওয়া এই চুক্তি বাস্তবায়নে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করবে।”
মাহমুদ আলী জানান, ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের পুরোনো আবাসস্থল বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাছাকাছি কোনো স্থানে পুনর্বাসিত করা হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল বা ব্যবস্থায় সীমিত সময়ের জন্য রাখা হবে।
২০১৬ সালের আগে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, নতুন করা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনার কথা নতুন সম্মতিপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-কে জড়িত করার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রয়োজন অনুযায়ী ইউএনএইচসিআর যথাযথ সময়ে সহযোগিতা করবে", সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বিবৃতিতে বলেন মাহমুদ আলী।
তিনি বলেন, “এই চুক্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এই চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থকে সুরক্ষিত করেছে। আমরা এটা নিয়ে খুশি। মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে।”