রোহিঙ্গাদের জন্য ঋণ নেবে বাংলাদেশ
2023.12.04
ঢাকা ও কক্সবাজার
বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা ও শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয়দের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।
সরকারের প্রত্যাশা, এই খাতে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ১০০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে, যার মধ্যে ঋণ প্রায় ৫৪ কোটি ডলার এবং বাকি ৪৬ কোটি ডলার অনুদান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ঋণ করা টেকসই সমাধান নয়, এতে বাংলাদেশের দায় বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে দু’টি দাতা সংস্থা এই অর্থায়ন সম্পর্কে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো ঋণ চাওয়া হয়নি।
গত ২৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সভার কার্যবিবরণীর একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।
সভায় জানানো হয়, বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে ৭০ কোটি ডলার এবং এডিবি থেকে ৩০ কোটি ডলারের আশ্বাস পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য “এডিবি ১৫ কোটি ডলার ঋণ ও ১৫ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে,” বলে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকীর বরাত দিয়ে জানানো হয় কার্যবিবরণীতে।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয় নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের জন্য “ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও নমনীয় ঋণের পরিমাণ কমতে থাকায় উইন্ডো ফর হোস্ট কমিউনিটিজ অ্যান্ড রিফিউজিস থেকে অর্থায়ন নেওয়া বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে,” বলে ওই সভায় জানান ওই সভায় ইআরডি সচিব।
এদিকে এই অর্থায়ন “ঋণ না হয়ে এটা অনুদান হওয়া উচিত ছিল,” বলে সোমবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা কেবল বাংলাদেশের নয়, এটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সমস্যা। ফলে এর দায়ভার কেবল বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।”
“বাংলাদেশ যদি নমনীয় ঋণ নেয়, তবু এটি শোধ করার দায় বাংলাদেশের ওপরই বর্তাবে,” বলে জানান জাহিদ হোসেন।
সহায়তা ‘অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে’
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নমূলক অভিযানে ২০১৭ সালে রাখাইন থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হন। এর আগে থেকেও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন। সব মিলে বর্তমানে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।
গত ছয় বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার।
শুরুতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা এলেও সম্প্রতি তা কমতির দিকে। ফলে বাধ্য হয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত জুনে রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ ১০ ডলার থেকে আট ডলারে নামিয়ে আনে। তার আগে এই বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছিল।
“রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্য থাকে। অতীতে ৬৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশের মতো তহবিল পাওয়া যেতো। এবার সহায়তার পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে,” সোমবার বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
“এ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪৫ শতাংশের মতো তহবিল সংগ্রহ হয়েছে,” বলে জানান তিনি।
ঋণ-অনুদান এলে ‘দৃশ্যত’ কিছু উপকার হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা চাই রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক।”
এই ঋণের সুদের হার কত হবে, তা কত বছর মেয়াদি হবে কিংবা আলোচনা বর্তমানে কোন পর্যায়ে রয়েছে—সে ব্যাপারে জানতে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকীকে ফোন করা হলেও তিনি বিস্তারিত তথ্য জানাতে রাজি হননি।
বেনারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঢাকা অফিসে সোমবার বিকেলে ইমেইল পাঠানো হলেও রাত এগারোটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত জবাব পাওয়া যায়নি।
যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের চিন্তা
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, এডিবি যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করতে সম্মত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সড়ক উন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুতায়ন ও স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার ছাড়াও ভাসানচরে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং সেখানে স্বাস্থ্য সেবা দেবার জন্য রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করা হবে।
এছাড়া এইসব অর্থায়নের আওতায় জন্ম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি, কক্সবাজার এবং ভাসানচরসহ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় পরিবেশগত সামগ্রিক ক্ষতি নির্ধারণে সমীক্ষা পরিচালনা, গ্রিনবেল্ট সৃষ্টি ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, স্থানীয় অধিবাসী ও রোহিঙ্গাদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প, রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রকল্প গ্রহণ, ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো ছোট আকারের ঘর নির্মাণ, মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচাতে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় ও নতুন পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হবে।
ঋণ নয়, অনুদান দেওয়া উচিত: টিআইবি
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ বাধ্য হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সোমবার টিআইবির এক বিবৃতিতে বলা হয়, “রোহিঙ্গা সংকটের মতো বৈশ্বিক মানবিক সংকট মোকাবিলার জন্য ঋণ নয়, সহায়তা অনুদান প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির সঙ্গে সরকারের আলোচনার করা দরকার।”
পাশাপাশি, এই নিপীড়নমূলক মানবিক সংকট মোকাবিলায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে ন্যায্য ও যথাযথভাবে এগিয়ে আসতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবি এটা প্রমাণ করার সুযোগ পেতে পারে যে, তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র নির্বিচার ঋণ ব্যবসায় সীমাবদ্ধ নয়।
বরাদ্দ কমায় ক্যাম্পে বাড়ছে অস্থিরতা
খাদ্য সহায়তায় অনুদানের অর্থ কমে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। তাঁদের ভাষ্য, এর ফলে ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা।
“আগে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ থাকলেও এখন কড়াকড়ির কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে খাদ্যের কষ্ট দিন দিন বাড়ছে,” সোমবার বেনারকে জানান টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম।
এ প্রসঙ্গে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা রমিদা বেগম বেনারকে বলেন, “যেখানে আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে উল্টো রেশন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন যে পরিমাণ রেশন দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।”
এখন সংসার চালাতে তাঁর স্বামী ও ছেলেরা “গোপনে ক্যাম্পের বাইরে কাজ করতে যায়,” বলেও জানান তিনি।