দুই মাসে ২১ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, প্রায় আড়াই হাজার ফেরত
2016.12.06

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে গত কয়েক সপ্তাহে প্রায় ২১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার এএফপির এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়।
এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ হাজার বলে জানিয়েছিল জাতিসংঘ। তবে স্থানীয়রা এ সংখ্যা ২০ হাজারের বেশিই বলেছিলেন। আর এখনো প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
সরকারের পক্ষ থেকেও আইওএম’র দেওয়া সংখ্যাটিকে ‘অনেকটাই সঠিক’ বলে মনে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “আইওএম পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখভালের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই তাদের দেওয়া সংখ্যাটি সঠিক ধরা যেতে পারে।”
আইওএম’র পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও অসহায় রোহিঙ্গাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
এ প্রসঙ্গে ঢাকায় আইওএম’র মিডিয়া প্রধান পেপ্পি সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “২০১৩ সাল থেকে কক্সবাজারে নিবন্ধনবিহীন মিয়ানমারের নাগরিকদের মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে আইওএম। এখানকার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় এক লক্ষ ব্যক্তির কাছে আমাদের সহায়তা পৌঁছেছে। তাদের জাতীয়তা, আগমনের তারিখসহ সার্বিক প্রয়োজন এবং শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের বিষয়ও এই সহায়তার অন্তর্ভুক্ত।”
এদিকে গত দুই মাসে আশ্রয় নিতে আসা প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা। পাশাপাশি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন। এ বিষয়ে ঢাকায় মিয়ানমার দূতাবাসে স্মারকলিপিও দিয়েছে একটি ইসলামী দল।
গত দুই মাসে প্রায় ২১ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে প্রবেশ করেছে বলে এএফপিকে জানিয়েছেন আইওএমের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান সংযুক্তা সাহানি।
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্য থেকে এই আওএম কর্মকর্তা বলেন, “গত ৯ অক্টোবরের পর থেকে চলতি মাসের ২ তারিখ পর্যান্ত আনুমানিক ২১ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে প্রবেশ করেছে।”
তবে নভেম্বরের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার মিয়ানমারের নাগরিক অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে বলে বেনারকে জানান পেপ্পি সিদ্দিক।
এর প্রায় এক সপ্তাহ আগে কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা হাফেজ আহমেদ নতুন করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার বলে বেনারকে জানিয়েছিলেন।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগ শরণার্থী শিবির ও স্থানীয় গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা যায়। এসব রোহিঙ্গারা তাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতন, গণধর্ষণ ও হত্যার ভয়াবহতার কথা তুলে ধরছেন।
নদীতে রোহিঙ্গা তরুণীর লাশ
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে বিভক্তকারীর নাফ নদী থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে নৌকাডুবিতে তিনি নিহত হয়েছেন।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল মজিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে বেনারকে বলেন, “লাশটি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নারীর বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারণ স্থানীয় কেউ লাশটির পরিচয় শনাক্ত করতে পারছে না।”
লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
গত সোমবার রাতে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে নাফ নদীতে একটি নৌকাডুবির ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। স্থানীয় জেলেরা রেহানা নামে একজন নারীকে উদ্ধারও করেন।
তবে বিষয়টি সত্য নয় জানিয়ে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বেনারকে বলেন, “উদ্ধার হওয়া রেহানা আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন- সহানুভূতি পাওয়ার জন্য তিনি নৌকা ডুবির ঘটনা সাজিয়ে বলেছেন। তবে রেহানা সত্যি খুব অসুস্থ। স্থানীয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তার এক আত্মীয়ের জিম্মায় তাকে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে।”
দুই শতাধিক নৌকা ফেরত
এদিকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় রোহিঙ্গা বোঝাই প্রায় দুই শতাধিক নৌকাকে গত দুই মাসে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মঙ্গলবার ভোরেও রোহিঙ্গা বোঝাই চারটি নৌকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বাধা পেয়ে মিয়ানমারের দিকে ফিরে গেছে।
“মঙ্গলবার ফেরত পাঠানো প্রতিটি নৌকায় ১৫ জনের মতো শিশু, নারী ও পুরুষ ছিল বলে জানান আবুজার আল জাহিদ।
তিনি জানান, “গত ১ নভেম্বর-৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত টেকনাফের ১৫টির বেশি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে দুইশ ২২ টি নৌকায় প্রায় ২ হাজার ২৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।”
তবে এরই মাঝে মঙ্গলবার টেকনাফ ও উখিয়ায় অন্তত ছয় শতাধিক রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীরা। আরো কয়েকটি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ভাসমান অবস্থায় দেখা গেছে।
মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়ের চেষ্টা
রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশের কট্টর মুসলিমরা ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে। তবে পুলিশের বাধায় তা পণ্ড হয়। প্রায় ১০ হাজারের মতো মুসলিম ওই মিছিলে অংশ নেয় বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।
কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা ঘুরে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে এসে ওই মিছিলে অংশ নেওয়া ফিরোজ মিয়া বেনারকে বলেন, “মাত্র ৬-৭ ফুট একটি ঘরে গাদাগাদি করে অমানবিক কষ্টের মধ্যে দিন পার করছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। ক্ষুধার্ত হয়েও খাবার নেই, অসুস্থ হয়েও চিকিৎসা নিতে পারছেন না, তারা।”
মিয়ানমারের দূতাবাস ঘেরাওয়ে বাধা পড়লেও দেশটির দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন নামে একটি দল। দলটির মহাসচিব ইউনুছ আহমাদের নেতৃত্বে সাতজন নেতা এদিন দুপুরে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন। এ ছাড়া আগামী ১৮ ডিসেম্বর মিয়ানমার অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন দলটির আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম।