শরণার্থী শিবিরে সশস্ত্র দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ২৪ ঘণ্টায় নিহত চার রোহিঙ্গা
2023.12.06
কক্সবাজার
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে বুধবার ভোরে সশস্ত্র দুই রোহিঙ্গা দলের মধ্যে গোলাগুলিতে তিনজন নিহত হয়েছেন। এর আগে একজনসহ ২৪ ঘণ্টায় চার রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার ঘটনায় শরণার্থীরা আতঙ্কে আছেন।
রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার বিষয়টি বেনারকে জানান ৮-এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উক্য সিং।
নিহতরা আরএসও সদস্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, “হঠাৎ ক্যাম্পে খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় আমরাও চিন্তিত। ...ক্যাম্প নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পরস্পরবিরোধী গ্রুপগুলো এ ধরনের সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।”
বুধবারের ঘটনায় নিহতরা হলেন; আবুল কাসেম (৩৫), মো. জোবাইর (১৯) ও মো. আনোয়ার সাদেক (১৮)। তাঁরা সবাই বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইমাম হোসেন (৩০) নামে আরেক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। “আরসা সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে,” হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বেনারকে জানান উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন।
বুধবারের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মঙ্গলবার মধ্যরাতে এই সংঘর্ষ হয় এবং বুধবার ভোররাতে ক্যাম্প থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গুলিবিদ্ধ দুই জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।”
তিন রোহিঙ্গার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ওসি শামীম বলেন, “আমরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যৌথ অভিযান চালাব। পাশাপাশি শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”
কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাবে, গত ২০ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিনে শরণার্থী শিবিরে ১০ রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন।
অন্যদিকে ২০১৭ সালের আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নমূলক অভিযানে ব্যাপকহারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর গত সাড়ে ছয় বছরে কক্সবাজারের ৩৩টি শরণার্থী শিবিরে ১৮৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
শিবিরে আতঙ্ক, ভয়
শরণার্থী শিবিরে নিয়মিত এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গারা।
বর্তমানে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে জানিয়ে কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা নুরুল হোসাইন বেনারকে বলেন, “এমনিতে ক্যাম্পে রেশন কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। এর মধ্যে আবার হত্যাকাণ্ড বেড়েছে।”
তহবিল সংকটের কারণে গত জুনে রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ ১০ ডলার থেকে কমিয়ে আট ডলারে নামিয়ে আনা হয়। এর আগে জনপ্রতি এই বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছিল।
“সব মিলিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গা খুব বিপদে আছে। বাংলাদেশ ছেড়ে অনেক রোহিঙ্গার ঝুঁকিপূর্ণ সাগরপথ পাড়ি দেওয়ার এটাও অন্যতম কারণ,” বলেন তিনি।
আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জুবায়ের বেনারকে বলেন, শিবিরে সশস্ত্র দলগুলো “প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত থাকায় ঝুঁকির মধ্যে আছেন সাধারণ শরণার্থীরা। এসবের একমাত্র সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।”
“সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণে আরসা এবং আরএসও’র দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে গেছে। ফলে সাধারণ রোহিঙ্গারা খুব ভীতির মধ্য রয়েছে,” বেনারকে জানান উখিয়ার বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবদুর রহিম।
শরণার্থী শিবিরে খুনের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত অপহরণের ঘটনাও বাড়ছে বলে বেনারকে জানান টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহামুদ আলী।
তিনি বলেন, এর ফলে “সাধারণ রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয়রা নিরাপত্তা হুমকিতে আছে। মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
এ ছাড়া শিবেরে অস্ত্রধারীদের ধরতে “যৌথ অভিযান চালানো হবে,” বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। তাঁদের মধ্যে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে কক্সবাজারে পালিয়ে আসেন।
গত ছয় বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার।
“কক্সবাজারের একটি ছোট জায়গায় ১০ লাখ মানুষকে দীর্ঘদিন রাখা “খুব কঠিন” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব জিয়া হাবীব আহসান।
তিনি বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে বড়ো ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন করা।”
“মিয়ানমার যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়, তাহলে তাদের তৃতীয় কোনো দেশে বা বিভিন্ন দেশে পাঠানোর বিষয়ে জাতিসংঘ ব্যবস্থা নিতে পারে,” বলেন জিয়া হাবীব।
তাঁর মতে, “সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা কার্যক্রম আরো বাড়ানো দরকার। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর মোতায়েন করা যেতে পারে।”
“তবে ক্যাম্পে বসবাসকারীদের খাবারের অভাব, চিকিৎসাসহ মানবিক বিষয়গুলোর প্রতিও সরকারসহ সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে,” বলেন তিনি।