রাখাইনে এক মাসেই ৬,৭০০ রোহিঙ্গা নিহত: জরিপ প্রতিবেদন

জেসমিন পাপড়ি
2017.12.14
ঢাকা
কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে সন্তান কোলে নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন এক রোহিঙ্গা নারী। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে সন্তান কোলে নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন এক রোহিঙ্গা নারী। ২৮ নভেম্বর ২০১৭।
রয়টার্স

আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর, ইস্টার্ন টাইম জোন বিকেল ০৩:০০

চলতি বছরের আগস্ট থেকে নতুন করে সৃষ্ট সহিংসতার প্রথম মাসেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রায় ছয় হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। নিহতদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৭৩০।

তবে এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত সংখ্যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মিয়ানমার।

বাংলাদেশের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে সংস্থাটি বৃহস্পতিবার নিহতের এই সংখ্যা প্রকাশ করে। এই সংস্থাটি ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স নামেও পরিচিত।

রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর ব্যাপকতা সম্পর্কে প্রকাশিত সর্বোচ্চ সংখ্যা এটি। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা রাখাইনে মৃতের সংখ্যা হাজারের মতো হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন।

এদিকে মাঠ পর্যায়ের ত্রাণ সংস্থাগুলোর জোট আইএসসিজির মতে গত আগস্ট থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখ ৫৫ হাজারের মতো।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পাওয়া সহিংসতার এসব তথ্যের ভিত্তিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিসি) মামলা হতে পারে বলে মনে করে এমএসএফ।

এর আগে রাখাইনে সেনা অভিযানে ৪০০ রোহিঙ্গা নিহত হয় বলে দাবি করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ, যাদের বেশির ভাগই জঙ্গি। তবে দাতব্য সংস্থা এমএসএফ’র জরিপ মিয়ানমারের ওই তথ্য উড়িয়ে দিলো।

সংস্থাটির দেওয়া এই পরিসংখ্যান সত্যের কাছাকাছি বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। এর মাধ্যমে রাখাইনে গণহত্যার চিত্র আরো স্পষ্ট হলো বলেও মনে করেন তাঁরা।

দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। তিনি বেনারকে বলেন, “এমএসএফ যে পরিসংখ্যান দিয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। অগ্রহণযোগ্য বলারও সুযোগ নেই। আমি মনে করি এ সংখ্যাটি সত্যের কাছাকাছি। হয়ত আরো একটু বেশি হতে পারে।”

“বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক বলয়ের সহযোগিতায় মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজছে, তখন এই পরিসংখ্যান একটি বড় শক্তি হয়ে উঠতে পারে। কারণ, এ ধরনের সংখ্যা এর আগে কেউ প্রকাশ করেনি,” মনে করেন নূর খান।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা। রাখাইনের সে অভিযানের ভয়াবহতার বর্ণনা করতে গিয়ে রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমার সেনারা বাড়ির পুরুষ সদস্যদের ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারীরা।

উখিয়ার কুতুপালং অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের বাসিন্দা নূর হাসিনা বেনারকে বলেন, “নিজের স্বামীকে চোখের সামনে মিয়ানমার সেনাদের হাতে মরতে দেখেছি। যুবতী দুই বোনকে তারা ধরে নিয়ে যায়, আর ফেরত পাইনি। শুনেছি ধর্ষণের পর তাদের মেরে ফেলেছে।”

জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনের এ ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও বরাবরই তা অস্বীকার করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তবে এবার সদ্য প্রকাশিত জরিপ প্রকাশ করে এমএসএফ-ও বলছে, এই হত্যা ব্যাপক সহিংসতার স্পষ্ট ইঙ্গিত।

৬৯ শতাংশকে গুলি করে হত্যা

এমএসএফ’র জরিপ অনুযায়ী, রাখাইনে নিহতদের মধ্যে ৬৯ শতাংশকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘরের মধ্যে পুড়িয়ে মারা হয়েছে নয় শতাংশকে। এছাড়া পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে পাঁচ শতাংশকে।

সংস্থাটি জানায়, নিহত শিশুদের ৫৯ শতাংশকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় ১৫ শতাংশকে আর পিটিয়ে হত্যা করা হয় সাত শতাংশকে। এ ছাড়া দুই শতাংশ মারা গেছে সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে।

রাখাইনের বর্বরতার শিকার হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে থাকা রোহিঙ্গারাও ভয়াবহতা নিয়েই বেঁচে আছেন বলে জানান এমএসএফের মেডিকেল ডিরেক্টর সিডনি ওয়াং।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এমএসএফ ডিরেক্টর চুক্তিটিকে ‘অপরিপক্ব’ উল্লেখ করে বলেন, এখনো রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসছে এবং সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতেও সেখানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে।

এই অবস্থায় এখনো রাখাইন রাজ্যে সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার সীমিত বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করে এমএসএফ।

প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে মিয়ানমারের সন্দেহ

এদিকে এমএসএফ’র তথ্যের সূত্র সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রতিবেদনে উল্লিখিত সংখ্যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মিয়ানমার।

জানতে চাইলে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, “আমরা জানি না এমএসএফ'র এই সংখ্যার ভিত্তি কী। যদি রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারী সেনাবাহিনী বা পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে এই ধরনের সংখ্যা বলা হতো, অথবা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ বা রাজ্য সরকার থেকে যদি তাঁদেরকে এই তথ্য দেওয়া হতো, তবে এটাকে সঠিক বলে ধরে নেয়া যেত।”

“এই সংখ্যা সম্পর্কে আমারা কোনো মন্তব্য করতে পারি না, কারণ এমএসএফ শুধুমাত্র একটি আন্তর্জাতিক এনজিও,” বলেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী।

সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাড়ির চেষ্টা রোহিঙ্গাদের

এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া থেকে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাড়ির প্রস্ততিকালে এক দালালসহ ৬ যাত্রীকে আটক করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে দুই জন রোহিঙ্গা বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কাঞ্চন কান্তি দাশের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল উপকূলের একটি বাড়ি থেকে তাদের আটক করে।

আটককৃতরা হলেন; টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের বড়ডেইল এলাকার নুরুল আমিন ওরফে নুর আলম (৪০), উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের আলী হোসেন(৪৫), রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের তাইগা কাটা গ্রামের মো. ছৈয়দ হোসেন(৩৯) ও মো. আলম (১৬), মিয়ানমার মংডুর বাঘগুনা থেকে আসা মো. হারুন মিয়া (২০) ও জিয়াউল হক (১৯)। রোহিঙ্গা দুজন কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের ডি ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন খান বেনারকে জানান, রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচারকারী একটি চক্র সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে এমন সংবাদ পেয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে টেকনাফের বাহারছড়া স্থানীয় দালাল নুরুল আমিন ওরফে নুর আলমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাঁচ মালয়েশিয়া যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে দুজন রোহিঙ্গা। এ ঘটনায় বাড়ির মালিককেও আটক করা হয়েছে।

এ ঘটনায় মানব পাচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তাদের শুক্রবার সকালে কক্সবাজার আদালতে পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা যুবক জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, “বছর খানেক আগে মিয়ানমার থেকে প্রাণে বাচঁতে মা-বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ না থাকায় দুঃখের জীবন কাটছিল। তাই স্থানীয় আজিজুর রহমান ও মো. কামালের প্রলোভনে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। গত মঙ্গলবার ১০ হাজার টাকা ওই দুই দালালকে দেওয়ার পর গতকাল রাতে তাদের মাধ্যমে ওই বাড়িতে অবস্থান নিই। বাকি টাকাগুলো মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর দেওয়ার কথা ছিল।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।