দেশে ফেরার সুযোগ নেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কক্সবাজার ছাড়ছেন রোহিঙ্গারা

বেনারনিউজ স্টাফ
2022.12.14
ব্যাংকক, ঢাকা, জাকার্তা, কুয়ালালামপুর এবং ওয়াশিংটন
দেশে ফেরার সুযোগ নেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কক্সবাজার ছাড়ছেন রোহিঙ্গারা নৌকায় ভেসে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের ক্রুয়েং গেউকুয়েহ সমুদ্র বন্দরে ১২০ জন রোহিঙ্গার একটি দল পৌঁছালে স্বাস্থ্যকর্মীরা এক শিশুকে সহায়তা করছেন। ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১।
[এপি]

দেশে ফেরার কোনো সম্ভাবনা না দেখে উন্নত জীবনের আশায় ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় খুঁজছেন বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, শরণার্থী শিবিরে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও শিশুদের শিক্ষার সুযোগের অভাবে মরিয়া হয়ে বিকল্প সন্ধান করছেন রোহিঙ্গারা।

মঙ্গলবার মিয়ানমারের জান্তা-বিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকারের এক উপদেষ্টা ইন্দোনেশিয়ার কাছে সাগরে ভাসমান একটি বিকল নৌকায় আটকে থাকা এক রোহিঙ্গার ফোন কলের রেকর্ড টুইটারে পোস্ট করেছেন।

অজ্ঞাতপরিচয় ওই রোহিঙ্গা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফোনে বলছিলেন, “আমাদের বাচ্চারা চার-পাঁচ দিন না খেয়ে আছে। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। দয়া করে আমাদের তীরে পৌঁছাতে সাহায্য করুন।”

কক্সবাজারের এক রোহিঙ্গা ঐ টেলিফোন সংলাপের প্রতিলিপি তৈরি করেছেন। প্রতিলিপি অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি ফোনে বলেছেন, “আমাদের নৌকায় একটি ৩ বছরের বাচ্চা অনাহারে মারা গেছে। বাকিরা সবাই এখনো বেঁচে আছি, কিন্তু আমাদের খাবার একদম ফুরিয়ে গেছে।”

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে ২০২২ সালের ১১ মাসে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে যাত্রা করেন। এর আগের বছর ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সাগর পাড়ি দেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিল ২৮৭। সমুদ্র পথে যাত্রা করে চলতি বছর অন্তত ১২০ জন রোহিঙ্গা মারা গেছেন।

চলতি মাসে আন্দামান সাগরে একটি ডুবন্ত নৌকা থেকে ১৫৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে মিয়ানমার নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। রয়টার্স জানিয়েছে, ভিয়েতনামের একটি নৌকা এই ভাসমান মানুষদের উদ্ধার করেছে। তবে অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম বলেছে, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশনের দুটি নৌকা ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্তে তাঁদেরকে ভাঙা নৌকা থেকে উদ্ধার করে।

বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও তার আশেপাশে বসবাস করছেন। যাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকারের রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়ন থেকে বাঁচার জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশ ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটি প্রত্যাবাসন পরিকল্পনায় সম্মত হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

“শরণার্থী শিবিরে অনেক লোক আছে যারা খুবই বঞ্চিত। যেহেতু তারা মাতৃভূমিতে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখছে না, তাই তারা উন্নত জীবনের আশায় এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করছে,” বেনারকে বলেন আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ জুবায়ের।

প্রত্যাবাসন না হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা অন্যত্র আবাসন খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে বল মনে করেন বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান।

বেনারকে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা মিয়ানমার সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড়ো দায়িত্ব।”\

rohingya2.jpg
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের লোকসুকোনের কাছে ড্রোন থেকে তোলা এই ছবিতে রোহিঙ্গা বহনকারী একটি নৌকা দেখা যাচ্ছে। ২৪ জুন ২০২২। [এপি]

নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যতের সন্ধানে রোহিঙ্গারা

আইন-ও-সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বেনারকে বলেন, শিক্ষা ও বিনোদনের সুযোগের অভাবসহ রোহিঙ্গাদের শিবির ত্যাগ করার অনেক কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, কক্সবাজারের উখিয়ায় ক্যাম্পের বাইরে একটি খেলার মাঠে ফুটবল খেলার অপরাধে এ মাসের শুরুতে প্রায় ৪০ জন রোহিঙ্গা যুবককে আটক ও জরিমানা করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা একটি নিরাপদ, টেকসই ভবিষ্যৎ চাইছে।

“রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। সেখানে জীবন-উপাদান ও জীবন-মান অত্যন্ত নাজুক ও অপর্যাপ্ত,” বেনারকে বলেন তিনি।

এক মাসেরও বেশি সময় সাগরে কাটিয়ে নভেম্বরের মাঝামাঝি ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের একটি উপকূলীয় গ্রামে শতাধিক রোহিঙ্গা পৌঁছেছিলেন।

রোহিঙ্গাদের এভাবে পালিয়ে বাঁচতে বাধ্য করার জন্য মিয়ানমারের জান্তাকে দায়ী করেছেন ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন ‘সিভিল সোসাইটি অ্যাসোসিয়েশন ফর রিফিউজি রাইটস প্রোটেকশনে’র নেত্রী আতিকা ইউয়ানিতা পরস্বতী।

“রাখাইন এবং বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের অবস্থা খুব নাজুক এটা সত্য। তারা সেখানে আটকে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না - এটাই তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে,” ইউয়ানিতা বলেন।

তিনি বলেন, “দেশটির এই অবস্থার জন্য মিয়ানমার সরকারকেই দায়ী করতে হবে।”

“২০১৬ সালের সরকারী প্রবিধি ১২৫ অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক হিসাবে তাদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে আমাদের বাধ্যবাধকতা আছে। আন্তর্জাতিক শরণার্থী কনভেনশন অনুমোদন না করলেও উক্ত বিধি অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ায় আগত শরণার্থীদের স্বাগত জানানো উচিত,” বলেন তিনি।

অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে – কিন্তু সবাই সফল হয় না।

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন অঞ্চলে ১৩ জন সম্ভাব্য রোহিঙ্গা নারীর মৃতদেহ উদ্ধারের পর কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করে।

বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদন মতে, স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, হয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অথবা যেসব দালালের মাধ্যমে এই নারীরা পালাতে চেয়েছিলেন, তারাই তাদের মেরে ফেলেছে।

২০১৭ সালের দমন অভিযানের সময় থেকে প্রায় সোয়া লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন শিবিরে আটক রয়েছেন। রেডিও ফ্রি এশিয়ার ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য একত্র করে দেখা গেছে, এ সময় স্থল ও জলপথে রাখাইন ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় ৮০০ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

rohingya3.jpg
ইন্দোনেশিয়ার উত্তর আচেহ উপকূলে রোহিঙ্গাদের তীরে উঠতে সহায়তা করছেন স্থানীয়রা। ২৫ জুন ২০২০,। [মুজাক্কির নুরদিন/বেনারনিউজ]

‘আশ্রয় চাওয়া অপরাধ নয়’

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশ থাইল্যান্ডের একজন মানবাধিকার কর্মী বেনারকে বলেছেন, পালানোর চেষ্টাকারী রোহিঙ্গারা পাচারকারীদের প্রতারণার খপ্পরে পড়তে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের প্রকল্প ‘দ্য ফোর্টে’র পরিচালক পুত্তানি কাংকুন বলেছেন, “আমাদের দেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে কিনা তা বলা মুশকিল। আমরা দেখেছি তারা সম্ভাব্য সব উপায়ে প্রবেশের চেষ্টা করছে। তারা সমুদ্র এবং স্থল উভয় পথেই আসে।”

তিনি বলেন, “থাইল্যান্ড সরকারের উচিত সাগরে ভাসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৌকা অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য জরুরিভাবে এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সমন্বয় করা।"

বিয়ন্ড বর্ডারস মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাহি রামকৃষ্ণান দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

বেনারকে তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সমুদ্রে মেরিটাইম এজেন্সি অফিসারদের পাঠানো, এই নৌকাগুলোকে খুঁজে বের করা, তাদের তীরে নিয়ে আসা এবং নিশ্চিত করা যে মানুষগুলোকে নিরাপদে নামানো হয়েছে। এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে আশ্রয় চাওয়া কোনো অপরাধ নয়।”

“প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে তাই নেতৃত্ব দেওয়া উচিত এবং এই নৌকাগুলো উদ্ধারের জন্য থাইল্যান্ডের মতো অন্যান্য আসিয়ান সদস্য দেশগুলো থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানানো উচিত। সমুদ্র আইন অনুযায়ী সমুদ্রে ভেসে যাওয়া নারী, শিশু এবং পুরুষদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে সব সরকারের বাধ্যবাধকতা আছে,” বলেন তিনি

“মালয়েশিয়া বাধ্যতামূলক প্রত্যর্পণ বিরোধী নীতির প্রতি দায়বদ্ধ। যে নীতি স্পষ্টভাবে বলে দেয় যে, আমরা এই আশ্রয়প্রার্থীদের এমন জায়গায় নির্বাসন করতে পারি না যেখানে তারা নিপীড়ন, সহিংসতা বা মৃত্যুর মুখোমুখি হবে,” বলেন মাহি।

rohingya4.jpg
বাংলাদেশ উপকূলে মালয়েশিয়াগামী নৌকা ডুবির পর কক্সবাজার টেকনাফে উদ্ধার হওয়া কয়েকজন রোহিঙ্গা। ৪ অক্টোবর ২০২২। [এএফপি]

পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা

সবচেয়ে বিপন্ন রোহিঙ্গার নিরাপদ পুনর্বাসন কর্মসূচির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি নির্বাচিত ৬৪ জন রোহিঙ্গার মধ্যে ২৪ জনকে গ্রহণ করেছে।

দেশটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে ইউএনএইচসিআর এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে তাদের সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, "বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে প্রান্তিক রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন শরণার্থী আশ্রয়দানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দীর্ঘকালীন নেতৃত্বেরই প্রতিফলন। কারণ বিশ্বজুড়ে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ যুদ্ধ, নিপীড়ন এবং অস্থিতিশীলতা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ায় নজিরবিহীন বাস্তুচ্যুতি সংকট তৈরি হয়েছে।”

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস জানিয়েছে, জাপান সরকারও কিছু রোহিঙ্গাকে সেখানে পুনর্বাসনের অনুমতি দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে।

“জাপান আপনাদের সরকারের কাছ থেকে তৃতীয় দেশে (রোহিঙ্গাদের) পুনর্বাসনের অনুরোধ পেয়েছে। এখানে ইউএনএইচসিআরও আমাদের সম্ভাবনা বিবেচনা করার পরামর্শ দিচ্ছে,” বাসসকে বলেন ঢাকায় জাপানের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। তিনি বলেন, বর্তমানে টোকিও থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে একটি শহরে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা বাস করছেন।

প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে আহম্মদ ফয়েজ, জাকার্তা থেকে পিজারো গোজালি ইদ্রুস, কুয়ালালামপুর থেকে নিশা ডেভিড, ব্যাংকক থেকে উইলাওয়ান ওয়াচারাসাকওয়েট এবং রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদকরা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।