ভাসানচর রোহিঙ্গাদের বসবাস উপযোগী করতে সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.12.17
ঢাকা
191217_Bhashan_Char_project_expanded_1000.jpg নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে নির্মাণ কাজ করছেন শ্রমিকরা। ১৫ অক্টোবর ২০১৮।
[এএফপি]

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ থেকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী​ স্থানান্তরের লক্ষ্যে আনুষঙ্গিক নানা সুবিধা বাড়াতে একটি সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই সংশোধনের বিষয়ে মতামত দিয়ে আসছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ভাসানচরের সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার কথা বেনারকে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান।

দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। সেখানেই তাদের সরিয়ে নেয়া হবে। তবে ভাসানচরকে আরও উন্নত করতে আমরা আজ একনেকে একটি সংশোধিত প্রকল্প পাশ করেছি।”

বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। এর আগে সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাতে সম্মতি দেয়নি। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাস উপযোগী ঘরবাড়ি প্রস্তুত হয়ে আছে।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আগে এই প্রকল্পটি যখন শুরু করা হয় তখন এর মধ্যে ২৯টি খাত ছিল। আর সংশোধিত প্রকল্পে ৪৩ ধরনের খাত রাখা হয়েছে।”

“প্রকল্পে নতুন খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভাসানচরের সাথে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগের জন্য বেসিনসহ একটি মেরিন জেটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত। এর ফলে বাণিজ্যিক জাহাজ এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য জাহাজ ভাসানচরে আসতে পারবে,” জানান তিনি।

এনামুর রহমান বলেন, “অন্যান্য খাতের মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য দুটি আলাদা চার তলা ভবন নির্মাণ। এ ছাড়া কবরস্থান নির্মাণ করা হয়েছে।”

'পিছু হটেনি সরকার'

নতুন সংশোধিত প্রকল্প অনুযায়ী, ভাসানচর “আরও নিরাপদ” হবে—এমন মন্তব্য করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থার সাথে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের কথা মাথায় রেখে আমরা ভাসানচর প্রকল্পটিকে রিভাইস করেছি।”

পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান বেনারকে বলেন, “আজ একনেক সভায় রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মাণাধীন ভাসানচর প্রকল্পটির সংশোধিত প্রকল্প পাশ হয়েছে। পূর্বের প্রকল্পের তুলনায় এই প্রকল্পে বেশ কয়েকটি খাত বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সাথে প্রকল্পটির খরচও বেড়েছে।”

তিনি বলেন, “২০১৭ সালে যখন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হয়, তখন মোট ২৯টি উপাদান ছিল। আর খরচ ছিল দুই হাজার তিনশ কোটি টাকা। বর্তমান সংশোধিত প্রকল্পে রয়েছে ৪৩টি খাত। আর খরচ বৃদ্ধি করে প্রায় তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, সংশোধিত প্রকল্প অনুযায়ী, ২০২১ সালে প্রকল্পটি শেষ করা হবে।

মন্ত্রী বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার চেষ্টা করছি, যদিও তাদের আমরা জোর করে সেখানে পাঠাব না। যদি তারা সেখানে না যায়, তাহলে আমরা আমাদের ভূমিহীনদের ভাসানচরে নিয়ে যাব।”

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য এখনও সম্মতি দেয়নি জাতিসংঘসহ এনজিওরা। আমরা জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থার মতামত অনুসারে প্রকল্পটি সংশোধন করেছি।”

মন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, “কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে সেখানে প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থান সংকুলান করা সম্ভব নয়। তাদের নতুন স্থানে স্থানান্তর করা খুবই জরুরি।”

অভিভাসন এবং শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “আজ একনেকে ভাসানচরের সংশোধিত প্রকল্প পাশ হওয়ার অর্থ হলো, এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানাস্তরের ব্যাপারে পিছু হটেনি সরকার। তারা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “তাদের প্রয়োজন ও পরামর্শ অনুযায়ী ভাসানচরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আরও ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তাদের জন্য ভবন নির্মাণ করছে।”

আসিফ মুনীর বলেন, “জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থার মতামত অনুসারে ভাসানচরে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তরের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে।”

তিনি বলেন, “ভাসানচরে সংশোধিত প্রকল্প পাশ করার মাধ্যমে সরকার মনে করছে, রোহিঙ্গাদের সহসাই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাবে না। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলা মামলা আরও কয়েক বছর চলতে পারে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করার দুটি কারণ রয়েছে।”

তিনি বলেন, “লাখ লাখ রোহিঙ্গার ক্যাম্পে কোনো কাজ নেই। এভাবে এতবড় জনগোষ্ঠী যদি বছরের পর বছর কর্মহীন থাকে, তাহলে সেখানে আরসাসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে নানাভাবে প্রলুদ্ধ করবে। সেটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—দুই দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”

অধ্যাপক শামসুর রেহমান বলেন, “আরেকটি কারণ হলো, উখিয়া-টেকনাফে স্থানীয় বাংলাদেশির সংখ্যা পাঁচ লাখের কিছু বেশি। আর সেখানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১২ লাখ। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ বাঁধবে।

রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে?

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়েছে ১৭৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী। মিয়ানমার নৌ বাহিনী তাদের আটক করেছে বলে জানিয়েছেন সামরিক মুখপাত্র জ মিন তুন।

তিনি বলেন, আটকদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হবে।

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর খবর নাকচ করে দিয়েছেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে রোহিঙ্গা পালানোর কোনো খবর নেই। তারা কিছুদিন পর পর সংবাদ মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আটকের খবর জানায়। তারা কোথায় পায় আমরা জানি না।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মাঝে মধ্যে তারা এও বলে যে, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে গেছে। কোথা থেকে নিয়ে গেলো, কখন নিয়ে গেল কিছুই আমরা জানি না।”

তিনি বলেন, “আমরা তো চাই তারা তাদের নাগরিকদের ফেরত নিয়ে যাক। রোহিঙ্গারা গেলে তো আমরা খুশি হতাম।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।