বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা, ধরা পড়ে মিয়ানমারে দণ্ডিত রোহিঙ্গাসহ ১০৯ জন
2021.12.17
বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার পথে সমুদ্রে ধরা পড়া রোহিঙ্গাসহ ১০৯ জনকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে মিয়ানমারের একটি আদালত। এদের মধ্যে দুইজন বাংলাদেশি এবং পাঁচ মিয়ানমার নাগরিকও রয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়া (আরএফএ) জানায়, গত ২৯ নভেম্বর মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে আটক হওয়া ২২৮ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের এক আদালতে অবৈধ অভিবাসনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে এই শাস্তি দেয়।
এদের সাথে থাকা ১৮ বছরের কম বয়সী ৯০ জন রোহিঙ্গাকে সতর্ক করে আদালত মুক্তি দেয়। এর আগে নৌকাটি ধরা পড়ার পরপরই ১০ বছরের কম বয়সী ৩৫ শিশুকে ছেড়ে দেয়া হয়।
আদালতে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করা আইনজীবী টিন হ্লাইং ও আরএফএ-কে জানান, সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে নৌযানটির ‘ক্রু’ হিসেবে কর্মরত মিয়ানমারের পাঁচ নাগরিক এবং দুই বাংলাদেশিকেও অবৈধ অভিবাসনের দায়ে মিয়ানমারের আইনে সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হয়েছে।
ওই রোহিঙ্গাদের সবাই ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।
রোহিঙ্গারা “অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাবার জন্য বাংলাদেশ থেকে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ২০১৭ সালের ঘটনার সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন,” জানান টিন হ্লাইং ও।
সাজাপ্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ তাঁদের আইনি প্রতিষ্ঠান থাজিন লিগ্যাল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন জানিয়ে টিন হ্লাইং ও বলেন, “তাঁদের পক্ষে আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।”
“বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের সহিংসতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে” তাঁরা মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করছিলেন বলে আরএফএকে জানান দণ্ডপ্রাপ্ত এক রোহিঙ্গার এক পরিবার সদস্য।
তিনি বলেন, “আমি নিজেও মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। কারণ শরণার্থী শিবিরে আর থাকা সম্ভব না।”
যেসব রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যরা মালয়েশিয়া রয়েছেন, তাঁরা সবাই সেখানে গিয়ে স্বজনদের সাথে মিলতে চান জানিয়ে ওই রোহিঙ্গা বলেন, “কেউ কেউ সেখানে বিয়ে করতে যায়। অনেকে ভাইবোনদেরও সঙ্গে নিয়ে যায়। যদিও এভাবে সেখানে যাওয়া সহজ নয়।”
বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করেন, যাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ এসেছেন ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পীড়নমূলক অভিযান শুরুর পর।
রাখাইনের মুসলিমরা এখনো নিষেধাজ্ঞার আওতায়
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাখাইন রাজ্যের বুথিডং শহরের একটি মুসলিম গ্রামের প্রধান জানান, রাখাইনে বসবাসকারী মুসলিমরা এখনো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। তাঁরা সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলার ব্যাপারেও সতর্ক। কারণ গণমাধ্যমে সমস্যার কথা জানানোর পরে প্রায়ই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়।
তাঁর মতে, “উন্নত জীবন খোঁজার চেষ্টা করার জন্য রোহিঙ্গাদের জেলে রাখা অন্যায্য ও অমানবিক।”
“এই দেশে আমরা যখনই গ্রেপ্তার হই, তখনই আমাদের দুই, তিন বা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা মোটেও ন্যায়সংগত নয়। এমনটা হওয়া উচিত না,” বলেন ওই মুসলিম গ্রাম প্রধান।
তিনি বলেন, “আমরা এখনো রাখাইন রাজ্যের কোথাও যেতে পারি না। আমাদের কোনো প্রয়োজনে, এমনকি স্বাস্থ্যগত সমস্যায় চিকিৎসার জন্যও আমরা মংডু বা রাজ্যের রাজধানী সিত্তেতে যেতে পারি না।”
“এ ক্ষেত্রে আমাদের ‘ফর্ম-ফোর’ নামের একটি বিশেষ ভ্রমণ নথি নিতে হয়, যা পাওয়া সহজ নয়,” যোগ করেন তিনি।
রোহিঙ্গা লিবারেশন কোয়ালিশন সিভিল সোসাইটি গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নে স্যান লুইন পরিস্থিতিটিকে “অগ্রহণযোগ্য” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “এ ধরনের কারাদণ্ড ন্যায্য নয়।”
“অভিবাসন আইনের ১৩(১) ধারা অনুযায়ী, সর্বনিম্ন সাজা ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। কিন্তু সামরিক বাহিনী দেখাতে চাচ্ছে যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনাকে পাত্তা দেয় না,” বলেন লুইন।