রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, প্রথম দল ফিরবে ২২ জানুয়ারির মধ্যে

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.12.19
ঢাকা
ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক (ডানে) ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব উ মিন্ট থু নিজ নিজ দেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্স স্বাক্ষর করেন। ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক (ডানে) ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব উ মিন্ট থু নিজ নিজ দেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্স স্বাক্ষর করেন। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭।
AFP

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছে। মঙ্গলবার ঢাকায় মিয়ানমার সরকারের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আলোচনার পর এই গ্রুপ গঠন করা হয়।

এদিকে রোহিঙ্গাসহ পারস্পরিক স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও তুরস্ক। বাংলাদেশ সফররত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ডেস্কের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমরা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করেছি। ৩০ সদস্যের গ্রুপে বাংলাদেশের ১৫ জন ও মিয়ানমারের ১৫ সদস্য থাকবেন। দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবেরা নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেবেন।”

তিনি জানান, ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় দুই পক্ষের সম্মতিতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কার্যপ্রণালী (টার্মস অব রেফারেন্স) সই হয়েছে।

মনজুরুল করিম আরও বলেন, “এই টার্মস অব রেফারেন্স অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পরিচালিত করতে কাজ করবে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ। প্রয়োজনে এই গ্রুপ রাখাইন রাজ্য ও বাংলাদেশে অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী জানুয়ারির ২২ তারিখের মধ্যে প্রথম ব্যাচের রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যাবে।”

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে। প্রথমে তাদের একটি নির্দিষ্ট অস্থায়ী আবাসস্থলে রাখা হবে। পরে দ্রুত তাদের নিজ নিজ গ্রামে পুনর্বাসিত করা হবে।

গত ২২ ও ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মিয়ানমার সফরে সিদ্ধান্ত হয়, নভেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। এরপর দুই দেশের মধ্যে টার্মস অব রেফারেন্সের খসড়া চালাচালি হয়। যে কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবারের আলোচনায় পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব উ মিন্ট থু তার দেশের ছয় সদস্যের নেতৃত্ব দেন। টার্মস অব রেফারেন্স সইয়ের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী উপস্থিত ছিলেন।

এ সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), প্রয়োজনে জাতিসংঘের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার সাহায্য নিতে পারবে।

এদিকে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কথা জেনেছেন এবং তাঁরা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সহায়তা করবেন বলে বেনারকে জানান ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র মোহাম্মদ আবু আসকার।

“আমরা প্রস্তাবনার জন্য অপেক্ষা করছি,” বলেন আসকার।

জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্সে বলা হয়েছে, রাখাইন থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর ও  ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আক্রমণের পর যারা বাংলাদেশে এসেছে মিয়ানমার তাদের প্রত্যাবসিত করবে। অক্টোবর ২০১৬ এর আগে যারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের পরবর্তীতে প্রত্যাবসিত করা হবে।

এখনো পুড়ছে রাখাইন, ফিরতে রাজি নয় রোহিঙ্গারা

এদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অক্সফাম মঙ্গলবার ‘রোহিঙ্গাদের কথা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রকাশ করা এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের দাবি যেন তাঁদের জোর করে ফেরত পাঠানো না হয়।

এতে আরোও বলা হয়েছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো সমান অধিকার ও পূর্ণ নাগরিকত্ব না দেওয়া হলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না।

রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ আলম (৩০) মঙ্গলবার টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “আমরা এখন যাব না। আমাদের ওপর মিলিটারিরা ও মগেরা আবার জুলুম করবে।”

“ওরা আমাদের আটকে রেখে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আমরা আগে দেখব তারা আমাদের নাগরিকত্ব দেয় কি না। এরপর দেখব ফিরে যাওয়া যায় কি না,” বেনারকে বলেন আরেক রোহিঙ্গা শরণার্থী নার্গিস।

এদিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি হওয়ার পরেও দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়িয়েছে বলে সোমবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)

গত অক্টোবর-নভেম্বরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অন্তত ৪০টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে জানায় সংস্থাটি।

এতে বলা হয়, নতুন করে পোড়া এই ৪০টি সহ রাখাইন রাজ্যে আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা রোহিঙ্গা গ্রামের মোট সংখ্যা ৩৫৪।

“বাংলাদেশের সাথে শরণার্থী প্রত্যাবাসন চুক্তি হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বার্মিজ আর্মি দ্বারা রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংসের ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি শুধু একটি কথার কথা ছাড়া কিছু নয়,” প্রতিবেদনে বলেন এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস।

ডিপথেরিয়া মোকাবেলায় বরাদ্দ ১৫ লাখ ডলার

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ডিপথেরিয়া মোকাবেলায় ১৫ লক্ষ ডলার বরাদ্দ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ইতিমধ্যেই সংস্থার পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জনবল ও সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি সম্ভাব্য ডিপথেরিয়া রোগী ও অন্তত ২১ জনের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে আগামী ছয় মাসে এই অর্থ ভ্যাকসিন কার্যক্রম, পরীক্ষাগার উন্নয়ন, রোগি শনাক্তকরণ ও চিকিৎকার কাজে ব্যয় করা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আগে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আগে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭।
ফোকাস বাংলা

 

একসাথে কাজ করবে বাংলাদেশ ও তুরস্ক

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাসহ পারস্পরিক স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও তুরস্ক।

বাংলাদেশ সফররত তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক করেন দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী।

“আমরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাসহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি,” বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিবৃতিতে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের সহায়তার হাত আরও সম্প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি দেন।

এর আগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন এবং পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সহযোগিতা বাড়াতে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারক সই করেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা।

এদিকে বুধবার সকালে কক্সবাজারে যাওয়ার কথা রয়েছে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর। সেখানে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন তিনি। এদিনই তুরস্কের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে তাঁর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে দু’দিনের সরকারি সফরে সোমবার রাতে ঢাকা পৌঁছান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পাশাপাশি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং রাতে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিনালি ইলদিরিম।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।