এ পর্যন্ত ৩৪ হাজার অনুপ্রবেশ, রোহিঙ্গা সমস্যায় আসিয়ানের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ
2016.12.20

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করতে আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ। দুই দিনের সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ সফরে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি এক সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে, তাকে এ আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দশটি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা আসিয়ানের অন্যতম সদস্য ইন্দোনেশিয়া।
পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারকেই ফেরত নিতে হবে বলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে।
দুই দিনের বাংলাদেশ সফরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার পাশাপাশি কক্সবাজারে অবস্থিত নিবন্ধিত ও অস্থায়ী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মঙ্গলবার রাতে ঢাকা ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন তিনি।
পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের জানান, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের অনিবন্ধিত নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে হবে।”
দেশটির সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আসিয়ান সদস্য দেশগুলো এ সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাটিকে প্রতিবেশী কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে না দেয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে বেনারকে জানান ইহসানুল করিম।
দুই দিনের সফর হলেও মূলতঃ ২৪ ঘণ্টার মতো বাংলাদেশে অবস্থান করেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে। যেখানে মূলতঃ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে।
সোমরার রাতে ঢাকা পৌঁছে মঙ্গলবার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক শেষে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে উখিয়া ও টেকনাফের সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ঢাকা মিশনের প্রধান শরৎ দাশ ও ইউএনএইচসিআর’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি শিনজি কুবো তাদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের কথা শোনেন। পরে তাঁরা কুতুপালং নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেন। তাঁরা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও কথা বলেন।
স্থানীয়রা জানান, দুই মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় অনেক রোহিঙ্গা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে সেনা ও পুলিশের দমন পীড়নের কাহিনী তুলে ধরেন এবং নিরাপদে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার দাবি জানান। এসময় মিয়ানমারে সহিংসতায় আহত কয়েকজনের সঙ্গেও একান্তে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এল পি মারসুদা।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রসাশক আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “ওনারা (দুই মন্ত্রী) সরেজমিনে এদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পুরো বিষয়গুলো দেখেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসময় রোহিঙ্গারা তাদের উপর চালানো অত্যাচার, নির্যাতনের কথা দুই মন্ত্রীকে শুনিয়েছেন।”
এ সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন - “ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উখিয়ায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে পরিষ্কার একটা চিত্র পেয়েছেন।”
মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে সরাসরি ঢাকায় আসায় তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আশা করি ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমারের সমস্যা সমাধানে সামনের দিনে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরাও আসিয়ানের প্রভাবশালী দেশ ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন।
তাঁদের মতে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের আগ্রহ বা সম্পৃক্ততা মিয়ানমারের উপরে কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর ইঙ্গিত বহন করে।
ইন্দোনেশিয়ার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা এখন অত্যন্ত জটিল একটি ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। এ বিষয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হলে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করা দরকার। সেটা আসিয়ানের মাধ্যমে হলে সবচেয়ে ভালো। কারণ, মিয়ানমারও আসিয়ানের সদস্য।”
তাঁর মতে, “ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রভাবশালী আসিয়ান দেশগুলো রোহিঙ্গা পরিস্থিতি অনুধাবন করলে, এ সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক তৎপরতা নিতে চায়, তা অনেকটাই সহজ হবে।”
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর তিনটি নিরাপত্তা চৌকিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন আরো অনেকে। এরপরই ওই অঞ্চলে অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তবে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। সে কারণে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উখিয়া সফরের পর এ নিয়ে আইওএম ও ইউএনএইচসিআর পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত অক্টোবরের পর এ পর্যন্ত প্রায় ৩৪ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।