জাতিসংঘ দূত জানালেন রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতি রয়েছে, বাংলাদেশের প্রত্যাখ্যান

জেসমিন পাপড়ি
2021.12.20
ঢাকা
জাতিসংঘ দূত জানালেন রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতি রয়েছে, বাংলাদেশের প্রত্যাখ্যান কক্সবাজার উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে একটি লার্নিং সেন্টার পরিদর্শনে যাচ্ছেন জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ (বামে)। ১৭ ডিসেম্বর ২০২১।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা হত্যা, নির্যাতন ও অপহরণে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) যুক্ত রয়েছে বলে দাবি করেছেন জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ।

এক সপ্তার বাংলাদেশ সফর শেষে রোববার ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে টম অ্যান্ড্রুজ এ কথা বলেন। এই প্রথম জাতিসংঘের কোনো প্রতিনিধি রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতি নিয়ে এমন মন্তব্য করলেন, পরবর্তীতে তিনি একই দাবি করেন জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত তাঁর বিবৃতিতে।

“আরসার সদস্যদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ ও ভয়ভীতি দেখানোর ব্যাপারে আমি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পেয়েছি,” লিখিতে বক্তব্যে তিনি বলেন।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেছেন বলেও জানান। পাশাপাশি তিনি রোহিঙ্গাদের, বিশেষ করে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাচলের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেন। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শও দেন টম অ্যান্ড্রুজ।

তবে শিবিরগুলোতে আরসার উপস্থিতির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

রোববার পৃথক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশে আরসা দেখিনি। কেউ তাদের কখনও দেখেনি। এখন কেউ যদি বলে, এখানে আরসা আছে, তবে তাদেরকেই তা প্রমাণ করতে হবে।”

“কারা আরসার নেতা-কর্মী তা দেখিয়ে দিতে হবে। আমরা ওদের ধরে তাঁদের দেশে পাঠিয়ে দেবো,” বলেন তিনি।

‘পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না

সাম্প্রতিক খুনের ঘটনা থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতির বিষয়টি ইঙ্গিত পাওয়া যায় বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরাও।

এ বিষয়ে এয়ার কমোডোর (অব.) ইশফাক এলাহী চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমাদের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি থাকলেও বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। আরসা গোষ্ঠী গহীন অরণ্যে বা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকতে পারে। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ খুনের ঘটনা উগ্রপন্থীদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে,” বলেন ইশফাক এলাহী।

“তবে আরসা নিয়ে জাতিসংঘ যদি উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে থাকে তাহলে তাদের উচিত হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা। অন্যথায় ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে বিরাট এই জনগোষ্ঠী থাকলে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে বাধ্য।”

“মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে আরসার সমর্থন আছে বলে এখান থেকে তারা আর্থিক-সামরিক সাহায্যও পেতে পারে। তাই নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকলে তাঁর উচিত হবে তা হস্তান্তর করে বাংলাদেশকে সর্বোতভাবে সহায়তা করা,” বলছিলেন ইশফাক এলাহী।

কক্সবাজারের শিবিরে রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা কিন মং সোমবার বেনারকে জানান, “ক্যাম্পে আরসা অস্তিত্ব নিয়ে জাতিসংঘের বক্তব্য সত্য। আমরা এ কথা আগে থেকে দাবি করে আসছিলাম। সরকারের উচিত আরসা সন্ত্রাসীদের নির্মূলে ধারাবাহিক অভিযানে অব্যাহত রাখা। কেননা রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।”

গত সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা নেতা মো. মুহিবুল্লাহ এবং পরের মাসে আরো ছয় রোহিঙ্গা খুনের পর থেকে কক্সবাজারে আরসার উপস্থিতির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তারা আল ইয়াকিন নামেও পরিচিত।

মুহিব উল্লাহকে হত্যার ঘটনায় রোহিঙ্গাদের এই জঙ্গি সংগঠন আরসা’র সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে অভিযোগ তুলেছেন নিহতের ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ; যিনি খুনের সময় ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, খুনিদের কয়েকজনকে তিনি চিনতে পেরেছেন। তবে বরাবরই আরসার উপস্থিতি অস্বীকার করে এসেছে সরকার।

এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যান্ড্রুজ জানান, আরসা নিয়ে নিরাপত্তার বিভিন্ন স্তরে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ করতে চাননি তিনি।

তবে অ্যান্ড্রুজ বলেন, “এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। সেখানে নানা রকম তৎপরতা নিয়ে লোকজন সতর্ক হয়ে উঠেছে। এ সমস্যাগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে কোনো তথ্য বিনিময়ের প্রয়োজন হলে আমি অবশ্যই তা দেবো।”

কক্সবাজার থেকে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) সামছু দ্দৌজা বেনারকে বলেন, “ক্যাম্প পরিদর্শনকালে আমরা জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ডরুজকে সরাসরি বলেছি যে, এখানে আরসার কোনো অস্তিত্ব নেই।”

গত সোমবার এক সপ্তাহের বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘের মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ। বাংলাদেশে তাঁর সফরের ওপর ভিত্তি করে ২০২২ সালের মার্চে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন তিনি।

স্কুল বন্ধে উদ্বেগ

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য পরিচালিত কিছু প্রাইভেট স্কুল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানান জাতিসংঘের দূত টম অ্যান্ড্রুজ।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষায় এসব প্রাইভেট স্কুলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বাংলাদেশের এই নতুন নীতি নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই সিদ্ধান্তের ফলে শিবিরে থাকা সকল প্রাইভেট স্কুল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”

শিক্ষার অধিকার রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে এবং রোহিঙ্গা যুবকদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি প্রাইভেট স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার আহবান জানান।

স্কুল বন্ধের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ফরটিফাই রাইটস।

গত ১৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী শিক্ষার অধিকার হারাবে।

এ বিষয়ে মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, “ক্যাম্পে প্রাইভেট কোচিং সেন্টার ছাড়া সকল প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। ফলে সকল শিশুদের পাঠদান অব্যাহত রয়েছে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে টম অ্যান্ড্রুজের সাক্ষাত বিষয়ে এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ইউনিসেফের অধীনে শিবিরে যে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষা কেন্দ্র আছে তার ওপরে এই সিদ্ধান্ত কোনো প্রভাব ফেলবে না। মূলত উগ্রবাদ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদানের কারণেই কিছু স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দাবি

রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জাতিসংঘের দূত বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই জীবিকার সুযোগ তৈরি করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভাসানচরে তাঁদের চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সেখানে নেওয়ার ক্ষেত্রে জোর করার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তিনি।

“রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে আমার কাছে স্পষ্ট, তাঁদের বেশিরভাগের মূল ভূখণ্ডের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখার করার ও ভ্রমণের সুযোগ নেই। প্রত্যেকে এটাকে বড়ো করে দেখিয়েছে,” বলেন তিনি।

এরই প্রেক্ষাপটে সোমবার এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটস বলেছে, “বাংলাদেশ সরকারের উচিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষা এবং সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা।”

এ প্রসঙ্গে রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “উনারা (জাতিসংঘ) রোহিঙ্গাদের ফ্রি মবিলিটি চান, আমরা তাদের ফ্রি মবিলিটি দিতে রাজি না।”

“উনাদের বক্তব্য হলো বাংলাদেশিদের মতো তাদের চলাচলের স্বাধীনতা দিতে হবে। এরা (রোহিঙ্গারা) আমাদের এখানে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য আশ্রয় পেয়েছে। তারা বাংলাদেশিদের মতো স্বাধীন চলাচল ও চাকরির সুযোগ পাবেন না,” বলেন ড. মোমেন।

“আমরা মনে করি, তাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে তাদের স্বদেশে। মিয়ানমার এ সমস্যা তৈরি করেছে, তারা এর সমাধান করতে পারে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা কিন মং বলেন, “আমরা স্বাধীনভাবে চলাচলের অনুমতি চাই। বিশেষ করে ভাসানচর থেকে কক্সবাজারে যাতে রোহিঙ্গারা তাদের স্বজনদের কাছে আসা-যাওয়া করতে পারে।”

২০১৭ সালের আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।

মন্তব্য

Robin
2021-12-21 06:44

বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। রোহিঙ্গারা দেশে মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিবেশ ধ্বংস করছে যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। তাছাড়া এই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। আমি মনে করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং দ্রুত সমাধান করা।