জানুয়ারির মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা
2017.12.28
ঢাকা
জানুয়ারির মধ্যে মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে প্রথম দফায় কমপক্ষে ৫০ হাজার শরণার্থীকে তাদের নিজভুমি রাখাইনে ফেরত পাঠাবে সরকার।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন তদারকি করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা বৃহস্পতিবার তাদের প্রথম প্রস্তুতির সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ডেস্কের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী গঠিত ৩০ সদস্যের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম সভায় মিলিত হবে। এই সভা মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
৩০ জনের মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার প্রত্যেকে ১৫ জন করে সদস্য দেবে। দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিবরা নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দেবেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই মুহূর্তে রাখাইন রাজ্যে নৃশংসতা নেই। একটি পত্রিকার জরিপ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, শতকরা ৭৮ জন রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যেতে চায়। তাই, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে নিজ বসতবাড়িতে ফিরে যাবে বলে আশা করছি।
বৃহস্পতিবার প্রথম প্রস্তুতির সভায় আলোচিত বিষয় সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী বেনারকে জানান, “আজ আমরা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা প্রস্তুতি সভায় মিলিত হয়েছি। আমরা আজকের সভায় মূলত প্রত্যাবাসন কীভাবে হবে এবং মিয়ানমার নাগরিকদের সেদেশের রেসিডেন্সি কীভাবে যাচাই করা হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের একটি বড় অংশ— সেই সংখ্যা ৫০ হাজার হোক আর এক লাখ হোক—জানুয়ারির মধ্যে ফিরে যাবে।”
“তবে সংখ্যা কত হবে সেটা নির্ভর করছে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া ও দুই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্যের ওপর,” বলেন মহাপরিচালক খান চৌধুরী।
তিনি বলেন, “আমরা আমাদের প্রস্তাবনা, অর্থাৎ কীভাবে আমরা ভেকিফিকেশন কাজ শেষ করব এবং কত দিনের মধ্যে সেগুলো শেষ করব সে সকল বিষয়গুলো জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভায় অনুমোদনের জন্য পেশ করবো।”
১৯৯২ সালে সম্পাদিত চুক্তির আলোকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি’র অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তিন্ত সোয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
ওই চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দুই মাসের মধ্যে শুরু হবে বলে বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ী, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ২২ জানুয়ারির মধ্যে শুরু হওয়ার কথা। এই চুক্তি অনুযায়ী, গত বছর ৯ অক্টোবর এবং এ বছর ২৫ আগস্ট রাখাইনে সংগঠিত সন্ত্রাসী হামলার পর যারা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমার ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের ফেরত নেবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত নয় লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করেছে বলে বৃহস্পতিবার তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
“জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভা আগামী জানুয়ারী ১৫ তারিখের মধ্যে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হবে। আর তারপরই প্রত্যাবাসন শুরু হবে,” বেনারকে বলেন শাহরিয়ার আলম।
তিনি বলেন, “প্রত্যাবাসন অবশ্যই জানুয়ারী মাসে শুরু হবে; কোনক্রমেই ফেব্রুয়ারি হবে না।”
রাখাইন থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ এখনো বন্ধ হয়নি, এই অবস্থায় জানুয়ারির মধ্যে কিভাবে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে প্রত্যাবাসন শুরু হবে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এখন খুব কম সংখ্যক মানুষ আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে আর কোন অ্যাট্রসিটির ঘটনা ঘটছে না; হয়তো ঘটানোর মত অবস্থা নেই। আর এখন যারা আসছেন তার কারণ হলো, সেখানে (রাখাইনে) বসবাসের সুবিধা নেই। খাবার নেই। আবার কেউ কেউ আসছেন তাদের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সদস্যদের খুজতে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের ওপর কোন চাপ প্রয়োগ করবে না। প্রত্যাবাসন হবে নিরাপদে ও স্বেচ্ছায়।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্সে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা যুক্ত থাকবে; তাই তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা হবে।”
শাহরিয়ার আলম বলেন, “রাখাইনে এখন কোন অবকাঠামো নেই। অনেক বন্ধু রাষ্ট্র রাখাইন সফর করে রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়ি-ঘর তৈরি করে দিতে চান। তারা তাদের জন্য আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করেছে।”
রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী নয় এমন ধারণা নাকচ করে একটি পত্রিকার করা জরিপ উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলম বলেন, “তাদের ৭৮ ভাগ মানুষ দেশে ফিরে যেতে চায়। আবার তাদের মধ্যে ছয় ভাগ বলেছেন, মিয়ানমারে যে অবস্থাই থাকুক না কেন তারা ফিরে যাবে।”
তবে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অক্সফামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, অধিকাংশ রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা রাখাইনে ফিরে যেতে চায় না। বিশেষ করে নারীরা ফেরত যেতে আগ্রহী নয়।
প্রতিবেদনটির একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে। এতে বলা হয়, যে নির্যাতনের কারণে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন সেই অবস্থার এখনো পরিবর্তন হয়নি।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ২৩ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
“আমাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে। আমরা গিয়ে কোথায় থাকব, কি খাব? আমাদের কাজ করার কোন সুযোগ নেই। কাপড়-চোপড় কিছু নেই। ওখানে গিয়ে আমরা কীভাবে বাঁচব?,” উখিয়া থেকে টেলিফোনে বেনারকে বলেন শরণার্থী আব্দুল আলী।
তিনি বলেন, “এখানে মানবেতর জীবন যাপন করতে আমরাও চাই না। কিন্তু এখানে আমরা কমপক্ষে নিরাপদে আছি।”
আলী বলেন, “এখানে কষ্ট আছে সত্য। কিন্তু কেউ তো আমার মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে জুলুম করে মেরে ফেলছে না। আরাকানের অবস্থা ভালো হলে আমরাই চলে যাবো। আরাকান এখনো ভালো হয়নি।”
এদিকে সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানাচ্ছে,, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আরও দুই মাসের জন্য রাখাইনের উত্তর অংশে কারফিউ বলবৎ রাখবে। বৃহস্পতিবারের দেয়া একটি ঘোষণায় এই তথ্য জানানো হয়। নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মংডুর প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, গত আগস্টে মংডুর একটি পুলিশ চৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি- আরসার আক্রমণের পর এই কারফিউ জারি করা হয়। যেটি এখনো চলমান রয়েছে।