তহবিল সংকটে অর্ধেকে নেমে আসছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা
2025.03.05
কক্সবাজার ও ঢাকা

‘মারাত্মক তহবিল ঘাটতি’র কারণ দেখিয়ে আগামী এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিমাসে মাথাপিছু বরাদ্দ সাড়ে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ছয় ডলার করার ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি)। জরুরি তহবিল না পেলে এটা করার কোনও বিকল্প নেই বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বুধবার রাতে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মিজানুর রহমান এ-সংক্রান্ত চিঠি পাওয়ার বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এমনিতেই রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ অপ্রতুল। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বরাদ্দ অর্ধেকে নামিয়ে আনা হলে বিরাট এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য-পুষ্টিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এর পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার আশংকার কথা বলেছে ডাব্লিউএফপি।
ডাব্লিউএফপি’র পক্ষ থেকে আরআরআরসি মিজানুর রহমানকে পাঠানো চিঠির অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, “প্রতি মাসে সাড়ে ১২ ডলার রেশন বহাল রাখার জন্য তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করলেও তারা দাতা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে৷”
“একাধিক দাতার কাছে তহবিলের জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং শুধুমাত্র খরচ সাশ্রয় করাটাই যথেষ্ট ছিল না,” বলা হয় চিঠিতে।
“পর্যাপ্ত তহবিল ছাড়া, এই জীবনরক্ষাকারী সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে হবে। ফলে, ১ এপ্রিল ২০২৫ থেকে ডাব্লিউএফপি প্রতি মাসে প্রতি ব্যক্তির খাদ্য ভাউচারের মূল্য সাড়ে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলার করতে বাধ্য হচ্ছে,” জানায় ডাব্লিউএফপি।
উল্লেখ্য, মাসে ৬ ডলারের রেশনের ফলে শরণার্থীরা বাংলাদেশি মুদ্রায় দৈনিক প্রায় ২৪ টাকা করে পাবেন৷ এতে করে এক বেলা খাবারের জন্য একজন রোহিঙ্গার বরাদ্দ হয় ৮ টাকা।
বুধবার রাতে কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামসু-দ্দৌজা বেনারকে বলেন, জনপ্রতি রোহিঙ্গার জন্য দেওয়া অনুদান অর্ধেকে কমিয়ে আনার ব্যাপারে একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। তাৎক্ষণিকভাবে তহবিল না পাওয়া গেলে এপ্রিল মাসের প্রথম দিন থেকে এটি কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে ডাব্লিউএফপি।”
সামসু-দ্দৌজা বলেন, “বিষয়টি এখনো আুনষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের জানানো হয়নি। তবে আমরা শিগগিরই রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। ”
মানবিক সহায়তা কমানোর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “এটি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহায়তা কমানোর ফলস্বরূপ করা হয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ছিল শরণার্থী সহায়তা কর্মসূচির প্রধান দাতা।”
মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) বরাতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে সংস্থাটি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে জরুরি খাদ্য ও পুষ্টি সহায়তা প্রদানে জাতিসংঘকে সহায়তা করে আসছে৷ এর মধ্যে রয়েছে খাদ্যের জন্য নগদ অর্থ স্থানান্তর, খাদ্য ভাউচার এবং খাদ্যদ্রব্যের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা৷
গত মাসে মিজানুর রহমান জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা তহবিলের ৫০ শতাংশেরও বেশি, অর্থাৎ প্রায় ৩০ কোটি ডলার দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷
ক্ষুধা ও দারিদ্রতায় অপরাধের ঝুঁকি বাড়বে
তহবিল সংকটে রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্য দেওয়া অনুদান অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) সভাপতি মোহাম্মদ জুবায়ের।
তিনি বেনারকে বলেন, “একজন মানুষ এতো কম বরাদ্দে কীভাবে চলবে? আমি হিসেব করে দেখেছি প্রতিদিন এক বেলা খাবারে একজনের বরাদ্দ সাত থেকে আট টাকা করে পড়ে। এই টাকায় যা জুটবে তাতে মানুষের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। ”
“অভাবের কারণে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়াবে। আবার অনেকে পেটের তাগিদে সাগরপথে ইন্দোশিয়া-মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করবে,” আশঙ্কা করেন তিনি।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “এ ব্যাপারে তিনি এই মূহুর্তে মন্তব্য করতে চান না। পরে বিস্তারিত জানানো হবে।”
এর আগে ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য রেশন কমিয়েছিল ডাব্লিউএফপি৷ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য রেশনের পরিমাণ মাসিক আট ডলারে নামিয়ে আনার ফলে ক্ষুধা ও অপুষ্টি তীব্রভাবে বেড়ে যায়৷ এমন সিদ্ধান্তের কয়েক মাসের মধ্যে শিবিরের ৯০ শতাংশ শরণার্থী পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে এবং ১৫ শতাংশের বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগতে শুরু করেন বলে জানিয়েছিল জাতিসংঘ৷ পরবর্তীতে রেশনের পরিমাণ কমানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়৷
বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসানচরে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সহিংসতার সময় পালিয়ে আসে।
বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কক্সবাজারের টেকনাফে আশ্রয় দেওয়া হয়। পরে জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান শুরু হয়, যা বহাল রয়েছে।