মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় রোহিঙ্গা ধর্ষণ ও গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ

কার্লোস জি হ্যামান
2023.06.13
ওয়াশিংটন ডিসি
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় রোহিঙ্গা ধর্ষণ ও গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কীভাবে তাঁর গলা কেটেছিল কক্সবাজারে একটি শরণার্থী শিবিরে তা দেখাচ্ছেন রোহিঙ্গা নারী রশিদা বেগম (২২)। ১ ডিসেম্বর ২০১৭। রশিদা জানান, “মিলিটারি অন্য পাঁচ নারীর সাথে আমাকে একটি বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করার পর ছুরি দিয়ে আমাদের গলা কেটে ফেলে। তারা ভেবেছিল আমি মারা গেছি। এরপর ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। ওখান থেকে আমিই একমাত্র জীবিত অবস্থায় পালিয়ে আসতে পেরেছি।” ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট হামলার পরপরই তিনি মিয়ানমারের তুলা টলি গ্রাম থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন।
[গেটি ইমেজ]

নারীদের গণধর্ষণ, শিশুদের ছুরিকাঘাত ও হত্যা এবং পুরুষদের গুলি করে বা পুড়িয়ে মারা হয়।

মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যা ও নৃশংসতার বিস্তারিত বর্ণনায় এমনই বিবরণ উঠে এসেছে আর্জেন্টিনায় চলমান এক মামলায়।

আর্জেন্টিনার ‘সর্বজনীন বিচারব্যবস্থা’ নীতির আওতায় মামলাটি দায়ের হয়েছে। এই নীতির আওতায় বিশ্বের যে কোনো দেশ ঘটা বিশেষ ঘৃণ্য অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারিক উদ্যোগ নিতে পারে দেশটি।

বুয়েনস আইরেসের একটি ফেডারেল আদালতে মঙ্গলবার মামলাটির শুনানি শেষ হতে চলেছে। এতে প্রথমবারের মতো সরাসরি রোহিঙ্গা সাক্ষীদের ব্যক্তিগত সাক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এই মামলাটি দায়ের করছিল লন্ডন-ভিত্তিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ‘বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে’। নিরাপত্তার কারণে আর্জেন্টিনায় মামলাটির কার্যক্রম চলছে রুদ্ধদ্বার আদালতে।

“মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের চারপাশে জাল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই বিচারে বোঝা যায় তারা বিশ্বের কোথাও ন্যায়বিচার থেকে পার পাবে না,” বলেছেন সংগঠনটির প্রধান তুন খিন।

২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মিয়ানমারে সংঘটিত নির্যাতনকে কেন্দ্র করে মামলাটি দায়ের হয়েছে। সামরিক জান্তা নেতা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং, উগ্র বৌদ্ধবাদী ধর্মগুরু আশিন উইরাথু এবং ক্ষমতাচ্যুত বেসামরিক নেতা অং সাং সু চি এতে আসামি হিসেবে আছেন।

আদালতে সংগঠনটির প্রতিনিধিত্ব করছেন টমাস ওজেয়া কুইন্টানা, যিনি ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক ছিলেন।

আক্রান্ত অঞ্চলে ওজেয়া কুইন্টানার নিজের কাজ, তার উত্তরসূরি ইয়াংহি লির কাজ এবং জাতিসংঘের ‘মিয়ানমারে স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন’ কর্তৃক ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে জমা দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মামলাটি তৈরি করা হয়েছে।

Rohingya-Argentina-2.2.JPG
কক্সবাজারের বালুখালী শরণার্থী শিবিরে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটা সেনুয়ারা বেগমের (১৬) দিকে তাকাচ্ছে এক শরণার্থী কিশোর। ৩০ নভেম্বর ২০১৭। ওই কিশোরের বাবা সায়েদুল রহমান জানিয়েছেন, ২০১৭’র আগস্টে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী মংডুর শাহাব বাজার গ্রামটি পুড়িয়ে ফেলার সময় সেনুয়ারার ডান হাঁটুর ওপরে উরুতে গুলি করেছিল। [রয়টার্স]

সহজ টার্গেট

রোহিঙ্গারা বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে। এই অঞ্চলটিতে অন্যান্যের মধ্যে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন জনজাতির বসবাস আছে।

আদালতে দায়ের করা ফৌজদারি অভিযোগ অনুসারে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে “গণহত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা” তৈরি করা হয়েছিল ২০১২ সালে, যখন একটি নামমাত্র নির্বাচিত সামরিক সরকার দেশের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থনের জন্য মিয়ানমারের মুসলমানদের এবং বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণা প্রচার শুরু করে।

কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হওয়া রোহিঙ্গারা ছিল সহজ টার্গেট।

“সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থার মধ্যে সমন্বিত পদ্ধতিতে ‘রোহিঙ্গা’ নামের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর পরিবর্তে তাদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়,” বলা হয় অভিযোগে।

এরপর কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ধর্মযাজকদের প্রচারণার মাধ্যমে এই ধারণা ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, ক্ষুদ্র মুসলিম সংখ্যালঘুরা “দেশটি দখল করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার” ষড়যন্ত্র করছে।

২০১২ সালের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার দুটি ঢেউ ১২টি জনপদকে প্রভাবিত করে। ২০১৩ সালে থান্ডওয়ে শহরে আরও সহিংসতা শুরু হয়। সে সময় কর্তৃপক্ষ ঘটনাগুলোকে “আন্তঃসাম্প্রদায়িক অস্থিরতা” বলে উড়িয়ে দেয়।

অভিযোগে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা এবং কামান নামে আরেকটি মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আক্রমণগুলো আসলে “সহিংসতা উসকে দিতে এবং উত্তেজনা বাড়াতে” মাসব্যাপী পরিকল্পনার অংশ ছিল। বিভিন্ন রাখাইন সংগঠন, কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু সংগঠন এবং বেশ কিছু কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এতে ইন্ধন দিয়েছিল।

নিরাপত্তা বাহিনী এর “অংশীদার ছিল। তারা প্রায়শই সহিংসতা বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছিল অথবা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।”

Rohingya-Argentina-2.3.JPG
মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যের মংডুর কাছে একটি পোড়া রোহিঙ্গা গ্রাম। ১২ নভেম্বর, ২০১৭। [রয়টার্স]

‘গণহত্যা পরিকল্পনা'

রাখাইনের রাজধানী সিটওয়ে এবং কিয়াউকপিউ শহরের প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, রাখাইনরা আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর সাধারণ মানুষ তা নেভাতে গেলে পুলিশ ও সৈন্যরা আগুন নেভাতে বাধা দিয়েছিল।

মংডুতে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, “নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে এবং গণগ্রেপ্তার করেছে।”

এইসব ঘটনার ফলে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

অভিযোগে বলা হয়, ২০১৫ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের পর অং সান সু চির বেসামরিক সরকারের সূচনা হবার পর “গণহত্যার পরিকল্পনা নিখুঁত হয়।”

“এ হলো ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর মোড়ক” যাতে “গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং শান্তির জন্য যারা তাঁদের জীবন দিয়ে লড়াই করেছিল, তাঁদের কর্তৃত্বের অধীনে নিকৃষ্টতম নৃশংসতা চালানোর অনুমতি দেয়া হয়,” মামলায় বলা হয়েছে।

২০১৭ সালের আগস্টে যখন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামের একটি ছোট, দুর্বল সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠী উত্তর রাখাইন রাজ্য জুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করে ১২ জনকে হত্যা করে তখন সহিংসতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়।

এর “কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিচালিত সামরিক প্রতিক্রিয়া ছিল মূলত তাৎক্ষণিক, নৃশংস এবং ব্যাপকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।” শত শত গ্রামজুড়ে তথাকথিত “নির্মূল অভিযান” চালানো হয়। এর ফলে এক বছরের মধ্যে প্রায় সাত লাখ ২৫,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল, নিহত হয়েছিল আনুমানিক দশ হাজার রোহিঙ্গা।

“ব্যাপকভাবে ধর্ষণ ও অন্যান্য ধরনের যৌন সহিংসতা সংঘটিত হয়েছিল। রাখাইন রাজ্যের অন্তত ১০টি গ্রামে তাতমাদো সৈন্যরা বড়ো আকারের গণধর্ষণ করেছে,” অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

Rohingya-Argentina-2.4.JPG
কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে মাথায় আঘাতের দাগ দেখাচ্ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী নূর কামাল (১৭)। ১৭ অক্টোবর ২০১৭। কামাল জানিয়েছেন, “সৈন্যরা মিয়ানমারের মংডুর কান পু গ্রামে এক তরুণ দোকানদারকে আমার বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে দেখে প্রথমে আমার মাথায় রাইফেলের বাট দিয়ে এবং পরে একটি ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিল।” [রয়টার্স]

গণহত্যা

সৈন্যরা নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে গুলি করে মারে। অন্যদের নিজেদের বাড়িতে পুড়িয়ে মারা হয়। রাখাইন পুরুষরা প্রায়শই লম্বা তরবারি ও ছুরি নিয়ে সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়।

“কখনও কখনও ৪০ জন নারী এবং বালিকাকে একসাথে ধর্ষণ বা গণধর্ষণ করা হয়। “সর্বোচ্চ অপমান নিশ্চিত করার জন্য” প্রায়শই জনসমক্ষে এবং তাদের পরিবারের সামনে ধর্ষণ করা হতো। নথিতে বলা হয়েছে, “জননেন্দ্রিয় অঙ্গচ্ছেদ এবং যৌন নির্যাতন” থেকে পুরুষ এবং ছেলেদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত আনুমানিক পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর মধ্যে, “অনেকে তাদের পিতামাতাকে হত্যা করার পরে বা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর একা পালিয়ে এসেছে।”

২০১৭’র ৩০ আগস্ট একটি বিশেষ জঘন্য ঘটনায় সৈন্যরা এবং সশস্ত্র জাতিগত রাখাইনরা মিন গি গ্রামে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায়।

সৈন্যরা পালানোর চেষ্টাকারীদের ওপর গুলি চালায়। আত্মসমর্পণকারী গ্রামবাসীদের ঘিরে ফেলা হয় এবং নারী ও শিশুদের পুরুষদের থেকে আলাদা করা হয়।

পুরুষদের জবাই করে মরদেহগুলো তিনটি গর্তে ফেলে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

নারীদের ঘরের ভেতরে নিয়ে লুট, ধর্ষণ এবং ছুরিকাঘাত করা হয়। শিশু ও নবজাতকদের হত্যা বা ছুরিকাঘাত করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়েছে, “যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তারা সবাই তাতমাদো সৈন্যদেরকে প্রধান অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।” পাশাপাশি নিপীড়নে জাতিগত রাখাইন “এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুরাও অংশ নিয়েছিল।”

ওই হামলায় অন্তত ৭৫০ জন নিহত হয়।

কম করে দেখানো

মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের তৎকালীন প্রধান অং সান সু চির সামনে সহিংসতার ঘটনাবলী প্রমাণসহ উপস্থাপন করার সময় তিনি এসব সহিংসতাকে খাটো করেছেন, এগুলোকে “ভুয়া খবর” এবং “ভুল তথ্যের ওপর চিত্র” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক আদালতে আরও দুটি মামলায় মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের তদন্ত শুরু করে। মিয়ানমার আইসিসির সদস্য নয়, তবে বাংলাদেশ সদস্য। তাই এই তদন্তের পরিধি সীমিত।

২০২০ সালের নভেম্বরে গাম্বিয়া জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য একটি রাষ্ট্র হিসাবে মিয়ানমারের দায়বদ্ধতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি মামলা দায়ের করে।

“মিয়ানমার থেকে বিশ্বের অপর প্রান্তের দেশ আর্জেন্টিনা। কিন্তু এখানেও বার্মিজ সামরিক বাহিনী ন্যায়বিচার এড়াতে পারছে না,” বলেছেন মামলার বাদী তুন কিন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।