ভোররাতে রোহিঙ্গা শিবিরে মাদ্রাসায় আক্রমণ, তিন শিক্ষকসহ অন্তত ছয় জনকে হত্যা
2021.10.22
কক্সবাজার
আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২১। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৪:১৫
রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সশস্ত্র মুখোশধারীদের হামলায় শুক্রবার ভোরে কক্সবাজারে তিন মাদ্রাসা শিক্ষক ও এক ছাত্রসহ ছয় রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
কক্সবাজার উখিয়ার বালুখালী শরণার্থী শিবিরে একটি মাদ্রাসার ভেতর ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে বেনারকে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার আশফাকুজ্জামান।
তিনি বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতের বেলা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে ক্যাম্প পাহারা শেষে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থিত 'দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসায় ঘুমাতেন।”
শুক্রবার ভোরে ঘুমের মধ্যে ওই স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর “অতর্কিত আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় একদল রোহিঙ্গা দুর্বৃত্ত,” বলেন তিনি।
পুলিশের তথ্য মতে, নিহতদের মধ্যে তিনজন মাদ্রাসা শিক্ষক, একজন মাদ্রাসার ছাত্র এবং দুজন মাদ্রাসা এলাকার বাসিন্দা।
হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ মোঃ ইদ্রিস (৩২), মাদ্রাসা ছাত্র আজিজুল হক (২২) নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দা মোঃ আমীন (৩২) ও ইব্রাহীম হোসেন (২৪)।
আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেবার পর মারা যান মাদ্রাসাটির অন্য দুই শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫) এবং হামিদুল্লাহ (৫৫)।
ওই হামলায় অন্তত ১২জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
হামলায় জড়িত সন্দেহে মুজিবুর রহমান নামে একজনকে ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে জানিয়ে খন্দকার আশফাকুজ্জামান জানান, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এপিবিএন-এর এই কর্মকর্তা জানান, মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের ধরতে চিরুনি অভিযান চালানো হচ্ছিল। এসব অভিযানে সাধারণ রোহিঙ্গাদের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করত। পাশাপাশি তারা ক্যাম্পে রাতে পাহারা বসাত।
“নিহত রোহিঙ্গারা রাতে ডিউটি শেষে মাদ্রাসায় ঘুমিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর গুলি চালায়, হামলা করে,” বলেন আশফাকুজ্জামান।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মূলত আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে সহযোগিতা করার কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা।”
“এর নেপথ্যে আর কোনো কারণ আছে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।
অভিযোগ আরসার দিকে
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র মো. রফিক (২৬) বেনারকে জানান, “শুক্রবার ভোরে হঠাৎ করে মাদ্রাসায় কান্নাকাটি শুনতে পাই। এ সময় ঘর থেকে বের হয়ে দেখি শ'খানেক মুখোশধারী লোক হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাদ্রাসার ওস্তাদ ও ছাত্রদের কোপাচ্ছে, গুলি করছে।”
কেউ কেউ বাঁচার জন্য মসজিদে ঢুকলে সেখানে ঢুকে তাঁদের কোপানো হয়েছে জানিয়ে রফিক বলেন, “আমার সামনে সব কিছু ঘটলেও কাউকে রক্ষা করতে পারেনি।”
এর আগে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) “মাদ্রাসাটি তাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ দেয়,” বলে জানান রফিক।
“কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি। মুহিব উল্লাহ হত্যার পর আরসা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কারণ তারা মনে করছে যে, মুহিব উল্লাহ হত্যার পর যেসব লোকজন পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে, তাতে আমাদের হাত রয়েছে।”
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে নিজ কার্যালয়ে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হাতে খুন হন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আরসা দায়ী বলে অভিযোগ করেছিল নিহতের পরিবার তবে পরবর্তীতে মুহিব হত্যায় তারা জড়িত নয় বলে এক বিবৃতিতে দাবি করে আরসা।
এছাড়া পুলিশও মুহিব হত্যাকাণ্ডের সাথে আরসার সম্পৃক্ততা নাকচ করে দেয়।
পুলিশ জানায়, মুহিব উল্লাহ খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত পাঁচ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের একজন মোহাম্মদ ইলিয়াছ কক্সবাজার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। ওই ঘটনার ২৩ দিনের মাথায় ঘটল এই ছয় রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ড।
ছোট ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে নিহত
শুক্রবারের আক্রমণের সময় মাদ্রাসায় অবস্থান করা ছোট ভাই নুর কদরকে (১২) বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারান তাঁর বড়ো ভাই আজিজুল হক।
তাঁদের মা সাজেদা বেগম (৫৫) দাবি করেন, “আমার ছেলেকে আরসার লোকজন হত্যা করেছে। তারা এর আগে আমার ছেলেকে তাদের দলের যোগ দিতে হুমকিও দিয়েছিল। আমি এ হত্যার বিচার চাই।”
“মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে এখানে এসেছি, আর এখন এখানে নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। এ বিপদ থেকে মুক্তি চাই আমরা," বেনারকে বলেন সাজেদা।
রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষাসহ তাঁদের অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য শরণার্থী শিবিরে ‘ইসলামী মাহাজ' নামে একটি কমিটি রয়েছে বলে বেনারকে জানান বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা দিল মুহাম্মদ (৬৭)।
নিহতদের কেউ কেউ এ কমিটির সদস্য ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “মূলত আরসায় যোগ না দেওয়ার কারণে এভাবে মানুষ মারা হচ্ছে।”
“মুহিব উল্লাহ হত্যার পর ব্লকে ব্লকে আমরা পুলিশের সঙ্গে পাহারা বসিয়েছি। এতে তারা আরো ক্ষুব্ধ হয়েছে। ফলে পরিকল্পনা করেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে," যোগ করেন দিল মুহাম্মদ।
এদিকে আরসা শরণার্থী শিবিরের “বেশিরভাগ মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করছে,” বলে বেনারকে জানান বালুখালী ১৮ ক্যাম্পের মাঝি মো. ইউনুছ।
“এর জন্য তারা আলাদা একটি কমিটি করছে, যারা আরসার পক্ষ হয়ে মাদ্রাসাগুলো দেখভাল করে,” বলেন তিনি।
তবে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠন আরসার কোনো উপস্থিতি নেই বলে বরাবর দাবি করে আসছেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।
‘তদন্তের পর কারণ জানা যাবে’
শুক্রবারের হত্যাকাণ্ডের “ঘটনা তদন্তের পর বিস্তারিত কারণ জানা যাবে,” বলে সাংবাদিকদের জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পর তিনি বলেন, “অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।”
“অনুমান করে কিছু বলতে চাচ্ছি না,” বলেন তিনি।
এদিকে “একদল দুর্বৃত্তের হামলায় ছয় জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে,” জানিয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দ্দৌজা নয়ন সাংবাদিকদের বলেন, “পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।”
সরেজমিন ঘটনাস্থল
শুক্রবার সকালে উখিয়ার বালুখালী শিবির সরেজমিন দেখা যায়, ক্যাম্পের এইচ ব্লকের যে মাদ্রাসাটিতে হামলা হয়েছে, সেটি ঘিরে রেখেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। মাদ্রাসার বাইরে সড়কে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য মোতায়েন রয়েছে। ওই এলাকার সাধারণ মানুষের বেশিরভাগের চোখেমুখে আতঙ্ক। নিহত পরিবারগুলোতে শোকের মাতম চলছে।
২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয় সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর কয়েক মাস পর পরই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে ৩২০ জন ছাত্র এবং ১৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। নতুন ও পুরানো মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে বাংলাদেশে।
রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামের দেওয়া হিসাব মতে, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানব পাচার, পুলিশ আক্রান্তসহ ১২ ধরনের অপরাধে গত চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছেন দুহাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। দিন যত গড়াচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৭৬টি, ২০১৮ সালে ২০৮টি, ২০১৯ সালে ২৬৩টি, ২০২০ সালে ১৮৪ মামলা হয়েছে। চলতি বছরের ছয় মাসে (জুন পর্যন্ত) মামলা হয়েছে ৫৬৭টি।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) ‘রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা: সহিংসতার মাত্রা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গত চার বছরের টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরগুলোতে ১০৮ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান বেনারকে বলেন, “বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালানো হচ্ছে এবং অপরাধীরা ধরা পড়ছে।”
“রোহিঙ্গা শিবিরে এখন একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তারা নিজ নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি ইয়াবা, অস্ত্র, স্বর্ণ চোরাচালানসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে,” বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন-এর সভাপতি মো. আয়াছুর রহমান।
“এ ছাড়াও আরেকটি গ্রুপ সক্রিয় আছে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করলে বা সরকারের সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা করলেই তাদের টার্গেট করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা,” বলেন আয়াছুর।
এদিকে শুক্রবারের হামলায় আহত সবাইকে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।