রোহিঙ্গাদের পরিচালিত স্কুল খুলে দিতে বাংলাদেশকে ২৫ সংগঠনের আহবান

আহম্মদ ফয়েজ ও আব্দুর রহমান
2022.04.28
ঢাকা ও কক্সবাজার
রোহিঙ্গাদের পরিচালিত স্কুল খুলে দিতে বাংলাদেশকে ২৫ সংগঠনের আহবান কক্সবাজারের বালুখালী শরণার্থী শিবিরে ইউনিসেফ পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্রে ক্লাস করছে রোহিঙ্গা শিশুরা। ২০ জানুয়ারি ২০১৮।
[রয়টার্স]

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের পরিচালিত স্কুলগুলো আবার চালু করতে বাংলাদেশে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ২৫টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।

বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ফর্টিফাই রাইটসসহ ২৫টি আন্তর্জাতিক সংগঠন এই দাবি জানায়।

সংস্থাগুলো জানায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের দ্বারা পরিচালিত প্রায় ত্রিশটি স্কুল বন্ধ করে দেয়।

“কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে কমিউনিটি শিক্ষার সুবিধা বন্ধ করা রোহিঙ্গা কমিউনিটির উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর এবং শিশুদের শিক্ষার অধিকারের চরম লঙ্ঘন, যা প্রজন্মটিকে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছে,” বলা হয় বিবৃতিতে।

এতে উল্লেখ করা হয়, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী নয় লাখ ৯২ হাজার ৫৬১ রোহিঙ্গার মধ্যে ৫১ শতাংশই শিশু।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়ে প্রায় সাত লাখ ৩৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন, যাকে জাতিসংঘ কর্তৃক জাতিগত দমন এবং সম্ভাব্য গণহত্যা বলে অভিহিত করা হয়।

সংস্থাগুলো উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর থেকে রোহিঙ্গা শিশুরা স্বীকৃত পাঠ্যক্রমের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

পড়াশোনা বন্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছে

মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার শিশুর জন্য মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

এই প্রোগ্রামটি চালু করতে বিলম্বের কারণে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় তাঁদের সন্তানদের কমিউনিটি স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করে আসছে, উল্লেখ করে অধিকার সংগঠনগুলো বলে, “রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অভিযোগ করেছে যে কিছু স্কুল শিক্ষককে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন আটক করেছে এবং শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটি কাগজে স্বাক্ষর করার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।”

“ছাত্রদের পাঠদান করা এবং তাদেরকে জীবনের সঠিক পথ দেখানো কোনো অপরাধ নয়। এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার,” ওই রোহিঙ্গা শিক্ষককে উদ্ধৃতি করা হয় বিবৃতিতে।

সংগঠনগুলো বলেছে, “কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের বলেছে, কমিউনিটি স্কুল পরিচালনা বা ভর্তির নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে তাঁদের শনাক্তকরণ কার্ড বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং প্রত্যন্ত ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর করা হবে।”

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, ৮-এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসেন বেনারকে বলেন “শিবিরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা হচ্ছে-এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে সেসময় কোনো শিক্ষকের সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করা হয়নি এবং কারো কাছ থেকে মুচলেকা নেয়া হয়নি।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রোহিঙ্গা শিশুদের

নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচয় গোপন রেখে একজন রোহিঙ্গা যুবককে উদ্ধৃতি করে বিবৃতিতে বলা হয়, “রোহিঙ্গা কমিউনিটির দাবি হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, যা মিয়ানমারে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উপযোগী হবে।”

অধিকার সংগঠনগুলো বলে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত সকল রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করে, তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী কমিউনিটি স্কুলকে আইনি মর্যাদা দেয়া।

কমিউনিটি স্কুল ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপর ক্র্যাকডাউন বন্ধ করার আহবান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আটক করা নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগে রয়েছে তা দ্রুত স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে তদন্ত শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য একটি ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতির অংশ হিসাবে শিক্ষা কার্যক্রম এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত এবং নির্দিষ্ট তহবিল বরাদ্দ করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছে অধিকার সংগঠনগুলো।

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির কতুপালংয়ের রোহিঙ্গা নেতা মো. সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য নির্মিত বাড়ি ও কমিউনিটিভিত্তিক স্কুল বন্ধের কারণে ৩০ হাজারের বেশি শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”

এর ফলে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেক রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়ছে। এতে অনেক শিশু-কিশোর-কিশোরী আলস জীবন কাটাচ্ছে।”

তিনি জানান, “শিবিরে অনেক অপরাধী সংগঠন বেকার কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ভেড়ানোর চেষ্টা করে থাকে। শিক্ষার অভাব অপরাধের জড়ানোর আশংকা বাড়িয়ে দেয়। তাই আমাদের দাবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হোক।”

এদিকে সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে কুতুপালং শিবিরে কেয়াফুরি স্কুলটি বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এ স্কুলটি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ চালু করেছিলেন।

এই স্কুলের শিক্ষার্থী মো. জুবায়ের (১৮) জানান, তাদের ফাইনাল পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমার ডাক্তার হবার স্বপ্ন। কিন্তু সেই সুযোগটি পাচ্ছি না পড়াশোনার সুযোগ না থাকায়। এখন আমার বেকার সময় কাটছে “

এ বিষয়ে লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম জানান, তার শিবিরে স্কুলগামী চার হাজারের বেশি শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

প্রতি বছর শিবিরে শিশুদের জন্ম হার বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কোনো কমিউনিটি স্কুল বন্ধ করার কথা অস্বীকার করেছে।

এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “আমরা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বা উচ্ছেদ করিনি। বরং সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু অবৈধ কোচিং সেন্টার উচ্ছেদ করেছি।”

প্রসঙ্গত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে শুধু ৪-১৪ বছর বয়সীদের জন্য ইউনিসেফ পরিচালিত শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর অনুমোদন রয়েছে।

ইউনিসেফের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হবার পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আবার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রায় এক লাখ বিশ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর আবার শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে।

ওই কেন্দ্রগুলো শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান শাহ্ রেজওয়ান হায়াত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।