মুহিব উল্লাহ হত্যার পর কক্সবাজারে ৩৮ রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার

আহম্মদ ফয়েজ ও আব্দুর রহমান
2021.10.12
কক্সবাজার ও ঢাকা
মুহিব উল্লাহ হত্যার পর কক্সবাজারে ৩৮ রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল, আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের কার্যালয় পরিদর্শনের সময় মুহিবের এক আত্মীয়ের কথা শুনছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন (মাঝখানে)। ৯ অক্টোবর ২০২১।
[সৌজন্যে: আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, কক্সবাজার]

গত মাসের শেষ দিকে আততায়ীদের হাতে শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ খুন হবার পর মঙ্গলবার পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে কমপক্ষে ৩৮ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এদের মধ্যে পাঁচ জন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ (৫০) হত্যা মামলায় এবং বাকিরা অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম। 

তিনি জানান, মুহিব হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারদের মধ্যে মোহাম্মদ ইলিয়াছ (৩৫) নামে একজন হত্যার সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা স্বীকার করে কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের কাছে ‘মাস্টার ইলিয়াছ’ নামে পরিচিত ইলিয়াছ উখিয়ার কুতুপালং-এর একটি শরণার্থী শিবিরের নেতা। গত ৩ অক্টোবর কুতুপালং থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে আর্মড পুলিশ (এপিবিএন)।

মুহিব হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার পাঁচজনকেই তিন দিন করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

এদিকে রোববার থেকে শরণার্থী শিবিরে অপরাধীদের ধরতে “একটি হটলাইন খোলা হয়েছে,” বলে বেনারকে জানান ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক।

“ক্যাম্পে যেকোনো অপরাধীর তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হটলাইনে খবর দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে তথ্য প্রদানকারীদের নাম গোপন রাখা হবে,” বলেন তিনি। 

হত্যার জন্য মিয়ানমার দায়ী: আরসার ভিডিও বার্তা

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা প্রধান হাফেজ আতাউল্লাহ আবু আমর জুনুনি সোমবার এক ভিডিও বার্তায় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ড মিয়ানমার সরকারের এজেন্সি করেছে বলে দাবি করেছেন।

এক ভিডিও বার্তায় জুনুনি বলেন, “রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। ঠিক তেমনি আরসাও মিয়ানমারের পূর্ণ অধিকার নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পক্ষে কাজ করছে।”

“আরসা আর মুহিব উল্লাহর কাজে তেমন কোনো ভিন্নতা ছিল না,” দাবি করে তিনি বলেন, “মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে আরসা কোনোভাবেই জড়িত নয়।”

“বরং মিয়ানমার সরকারের এজেন্ট বা কোনো একটি আন্তর্জাতিক এনজিও যারা রোহিঙ্গারা ফিরে যাক চায় না, এমন কেউ এ ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে আরসা’র ওপর দোষ চাপিয়ে ফায়দা লুটতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে,” বলেন জুনুনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এ ভিডিও সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, “মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন বার্তা দিয়ে অডিও ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো নিয়ে পুলিশের আলাদা টিম কাজ করছে। সর্বশেষ আরসার একটি ভিডিও বার্তা বের হয়েছে। সেটি আমরাও দেখেছি। তা নিয়েও আমরা কাজ করছি।” 

শরণার্থী শিবিরে পররাষ্ট্র সচিব

গত শনিবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে মুহিব উল্লাহর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।

পরিদর্শনকালে পররাষ্ট্র সচিব ঘটনার রাতের (২৯ সেপ্টেম্বর) বর্ণনা শোনেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে। পরে শিবির ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় শরণার্থী শিবিরে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেয় পুলিশ।

পররাষ্ট্র সচিবের সাথে কথা বলেছেন নিহত মুহিব উল্লাহ’র ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা কয়েকজন আলাদাভাবে সেই রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাসহ হত্যাকারীদের সম্পর্কে যা দেখেছি এবং জানি সেসব বিষয় তুলে ধরেছি।”

“প্রতিনিধি দল শুরুতে জানতে চেয়েছে ভাইয়ের হত্যাকারীরা কি আরসা? জবাবে হ্যাঁ বলেছি। পাশাপাশি আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্যও বলেছি,” বলেন হাবিব।

অফিসে ঢুকে কীভাবে মুহিব উল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে সেটি জানানোর কথা উল্লেখ করে এআরএসপিএইচআর-এর ভাইস-চেয়ারম্যান মাস্টার আবদুর রহিম বেনারকে বলেন, “তাঁদের কাছে আমরা কীভাবে নির্মমভাবে আমাদের চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে সেটি তুলে ধরেছি।”

“প্রতিনিধি দল আগামীতে সংগঠনের কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে জানতে চায়। পুরোপুরি নিরাপত্তা পেলে আমরা এ সংগঠন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি,” যোগ করেন রহিম।

প্রতিনিধিদল মুহিব উল্লাহ’র পরিবারসহ তাঁদের কয়েকটি পরিবারকে “উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট পয়েন্ট এলাকার সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব” দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু তাঁরা “যেখানে রোহিঙ্গা নাই, অর্থাৎ কক্সবাজার শহরের দিকে” তাঁদেরকে সরিয়ে নেবার আবেদন জানান।

“তবে এ ব্যাপারে সচিব কোনো জবাব দেননি,” বলেন রহিম। 

এদিকে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে শনিবার বিকেলে ঢাকায় যাওয়ার পথে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, “মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।”

শিবির পরিদর্শনকালে বিভিন্ন রোহিঙ্গা নেতা ও মুহিব উল্লাহর পরিবারের সাথে কথা বলেছেন জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। ক্যাম্পে কোনো ধরনের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না।”

তবে রোহিঙ্গাদের সাথে আলাপের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি সচিব।

ক্যাম্পে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ

নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) যুক্ত হওয়ায় মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে উখিয়া কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল করেছেন রোহিঙ্গারা।

এ সময় রোহিঙ্গাদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেন ক্যাম্পের মাঝিরা (নেতারা)। একই সঙ্গে ভাসানচরে যেতে রাজি তাঁরা।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর-এর চুক্তি হওয়ায় “রোহিঙ্গারা আনন্দিত,” জানিয়ে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-২ রোহিঙ্গা মাঝি মোহাম্মদ আমিন বলেন, “ক্যাম্প থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই ভাসানচরে যেতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।”

এর আগে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গারও আনন্দ মিছিল করেছে রোববার। 

শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও সরকারের মধ্যে এই সমঝোতা স্মারক সই হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন এবং বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ইয়োহানেস ফন ডার ক্লাউ সই করেন এই দলিলে। 

এই চুক্তির আওতায় ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, মিয়ানমার কারিকুলাম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকায়নের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের সঙ্গে এ কাজে সহায়তা করবে ইউএনএইচসিআর।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।