রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যাকাণ্ড: নিহতদের ঘনিষ্ঠ ১৭ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে

আবদুর রহমান ও শরীফ খিয়াম
2021.10.29
কক্সবাজার ও ঢাকা
রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যাকাণ্ড: নিহতদের ঘনিষ্ঠ ১৭ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সাথে ত্রাণ সংকট বিষয়ে আলোচনা করছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ (মাঝখানে)। ৭ এপ্রিল ২০১৯।
[রয়টার্স]

কক্সবাজারের উখিয়ায় নিহত শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর স্ত্রী-সন্তানসহ মোট ১৭ পরিবারের ৭৩ জন সদস্যকে শরণার্থী শিবির থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ ২২ অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলায় যে ছয় রোহিঙ্গা নিহত হন, তাঁদের পরিবারের ৩১ সদস্যকে বুধবার বালুখালী ক্যাম্প থেকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ট্রানজিট সেন্টারে নেওয়া হয়েছে।

দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় নিহত ছয় রোহিঙ্গার স্বজনদের ইউএনএইচসিআরের সেন্টারে নেওয়ার তথ্য শুক্রবার বেনারকে নিশ্চিত করেন রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (৮ এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসেন।

“বিষয়টি এমন নয় যে তাঁরা ক্যাম্পে অনিরাপদ ছিলেন। তবে এভাবে পরিবারের সদস্য মারা যাওয়ায় সবাই খুব আতঙ্কিত ছিলেন। যে কারণে নিজেদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে তাঁদের ক্যাম্প থেকে সরিয়ে ‘ট্রানজিট পয়েন্টে’ রাখা হয়েছে,” বেনারকে বলেন তিনি। 

ট্রানজিট সেন্টার থেকে মাদ্রাসায় নিহত আজিজুল হকের বাবা নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পের তুলনায় এখানে ভয় কম। তাই আমরা এখন সেখানকার চেয়ে ভালো আছি। কিন্তু আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে কী আর ফিরে পাব?” 

হত্যাকাণ্ডের পরদিন দায়ের হওয়া মামলার এই বাদী আরো বলেন, “আমরা চাই এসব অপরাধীর কঠোর শাস্তি হোক। অন্যথায় ক্যাম্পগুলোতে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে।” 

ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান বলেন, “সব অপরাধীকে ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহল জোরদার করা হয়েছে।”

তিনি জানান, ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলিতে মুহিব উল্লাহ খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে নয় রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে ২৩ অক্টোবর আজিজুল হক এবং ১০ অক্টোবর মোহাম্মদ ইলিয়াছ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এর আগে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর পরিবারকে ১৩ অক্টোবর ক্যাম্প থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরদিন তাঁর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) আরো ১০ নেতার পরিবারকে একটি সেন্টারে নিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান ১৪ এপিবিএন’র অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক। তিনি বেনারকে বলেন, “সেখানে তাঁদের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।”

“মূলত মুহিব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ঘটনাস্থল থেকে মোট ১১টি পরিবারের ৪২ জনকে সরিয়ে নেওয়া হয়,” যোগ করেন তিনি।

তবে নিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে সেন্টারটির অবস্থান এই পুলিশ কর্মকর্তা বা ওই পরিবারগুলো জানাতে চায়নি। 

নিরাপত্তার কারণে কোথায় আছেন তা ‘বলা ঠিক হবে না’ জানিয়ে নিহত মুহিবের ভাগ্নে ও এআরএসপিএইচ মুখপাত্র রশিদ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “এখানে আমরা ক্যাম্পের তুলনায় স্বস্তিতে আছি।”

বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মো. ইউনুছ বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটায় এখানকার বাসিন্দাদের সবাই খুব ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে। এখনো রাতের আঁধারে সন্ত্রাসীরা ঘোরাফেরা করছে। যে কারণে সন্ধ্যার পর অনেকে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।” 

তৃতীয় দেশে আগ্রহ তাদের

জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে না থেকে কোনো ‘থার্ড কান্ট্রিতে’ যেতে চাইছে এই ১১টি পরিবার।

এ ব্যাপারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার(আরআরআরসি), ইউএনএইচসিআর এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে উল্লেখ করে রশিদ বলেন, “ওই সব দেশের সঙ্গে ই-মেইলের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।”

তবে “আমাদের কাছে মুহিব উল্লাহর পরিবার কোনো আবেদন করেনি,” জানিয়ে আরআরআরসি শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “তা ছাড়া এ বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারের বাইরে।”

“তারা যদি কোনো দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে যেতে চায়, সেক্ষেত্রে সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এ বিষয়ক নথি আমাদের কাছে আসবে,” যোগ করেন সরকারের এই অতিরিক্ত সচিব। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মিয়া মো. মাইনুল কবির বেনারকে বলেন, “অনেক সময় কিছু দেশ রোহিঙ্গাদের নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো প্রস্তাব আমরা পাইনি।”

রোহিঙ্গারা তৃতীয় দেশে যেতে চাইলে সরকারের ‘ক্লিয়ারেন্স’ দরকার হবে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, “কোনো দেশের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পাওয়া গেলে সেটা আমাদের ‘পলিসির’ সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা তা যাচাই-বাছাই করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রোহিঙ্গা বেনারকে জানিয়েছেন, আবেদনে তারা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার নাম উল্লেখ করেছেন। সেসব দেশ এবং ইউএনএইচসিআরের সাথে আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এআরএসপিএইচ সদস্য মোহাম্মদ নওখিম। 

তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি নওখিম।

এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের একাধিক কর্মকর্তাকে ই-মেইল পাঠিয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। 

তৃতীয় দেশে যাওয়া নতুন নয়

অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বেনারকে জানান, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ২০০৯-১০ সালে ৯২৬ জন নিবন্ধিত শরণার্থীকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে।

সে সময় পুরো প্রক্রিয়াটির নেতৃত্ব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। ইউএনএইচসিআর এবং আইওএম এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল। তবে তখনও রোহিঙ্গাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ক্লিয়ারেন্স’ নিয়েই যেতে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে সরকার মনে করছিল, শুধুমাত্র পশ্চিমা দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়ে যেতে পারে। যে কারণে এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন যেহেতু নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সরকারের এটা আনুষ্ঠানিকভাবে মোকাবেলা করা উচিত।”

“কোনো রোহিঙ্গা যদি তৃতীয় দেশে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে থাকে, তবে তারা যেতে পারে। তাদের সেই অধিকার রয়েছে এবং এটা সম্ভব। তবে এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই হতে হবে এবং এক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআর এর সংশ্লিষ্টতাও প্রয়োজন হবে,” উল্লেখ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।