মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে যোগ না দিলে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি
2024.05.30
রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটওয়েতে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। রোহিঙ্গারা সামরিক প্রশিক্ষণে যোগ দিতে রাজি না হলে বাস্তুচ্যুত আশ্রয় শিবিরে মাসিক আন্তর্জাতিক সাহায্য সরবরাহ বন্ধ করে দেবার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
যুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গা এবং জাতিগত রাখাইন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে সফল হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সেখানে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন নতুন করে আহ্বান জানাচ্ছে, তখন রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগের খবর এসেছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি এবং বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ব্যাপক আত্মসমর্পণের কারণে তাতমাদো নামে পরিচিত মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে সৈনিকের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় জান্তা নতুন সৈন্য নিয়োগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে কয়েক দশক ধরে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে জাতিগত আরাকান আর্মি (এএ) এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে।
উভয় পক্ষই রোহিঙ্গাদের তাদের দলে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে এবং একই সাথে উভয়পক্ষই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিপক্ষকে সহায়তা করার অভিযোগ আনছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যালঘুরা আরাকান আর্মি এবং জান্তা বাহিনী উভয়ের সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
সিটওয়ের রোহিঙ্গা বাসিন্দারা নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে (আরএফএ) বলেছেন, জান্তা সৈন্যরা ২৭ মে প্রত্যেকটি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শিবির থেকে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী অন্তত ৩০ জন সদস্যকে সেনা প্রশিক্ষণের জন্য সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া শুরু করে।
অন্তত ১০টি শিবিরের বাসিন্দাদেরকে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঠেট কেই পাইন, ওহন টাও গি, বার সার রা, ডার পাইং এবং ঠাই চাউং।
ঠেট কেই পাইন ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা বাসিন্দা বুধবার বলেন, “আমাদের ক্যাম্প থেকে ৩৫ জনকে দিতে বলা হয়েছিল। যদি আমরা তা না করি, তারা আর [আন্তর্জাতিক] খাদ্য সরবরাহ করবে না। জান্তা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার জন্য তাদেরকে নিয়োগ করছে।”
শিবির থেকে ঠিক কতজন রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক নিয়োগ করা হয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হয়নি।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা বন্ধের হুমকির ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে মিয়ানমারে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও বুধবার পর্যন্ত উত্তর পায়নি আরএফএ।
রোহিঙ্গারা আরএফএকে বলেছেন, জান্তা আর্মি মার্চ মাসে সিটওয়ে শহরের বাস্তুচ্যুতদের ক্যাম্প থেকে প্রায় ১০০০ রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক সামরিক চাকরিতে নিয়োগ করেছিল। গত মাসে রোহিঙ্গা গ্রাম থেকে ৩০০ জনেরও বেশি নিয়ে গেছে। এবার জোরপূর্বক নিয়োগের তৃতীয় ধাপ চলছে।
এখন পুরুষরা বাইরে ঘুমায়
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটওয়ের এক রোহিঙ্গা বলেছেন, মাঝরাতে আটক হওয়ার ভয়ে তাঁর সম্প্রদায়ের সদস্যরা আর বাড়িতে ঘুমাতে চায় না।
“তারা [জান্তার সৈন্যরা] প্রায়ই গভীর রাতে আসে এবং যদি তারা বাড়িতে যুবকদের দেখে তবে নিয়ে যাবে," তিনি বলেন।
“আমাদের জন্য আর ঘরে ঘুমানো ভালো নয়। এখন পুরুষরা বাইরে ঘুমায়,” বলেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের জন্য আগেরবার সামরিক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল জান্তা বাহিনীর সিটওয়ে-ভিত্তিক আঞ্চলিক কমান্ড সদরদপ্তরে। রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সনদপত্র দেওয়া হয়। তারপর কিছু লোককে বাড়িতে এবং অন্যদের সামনের সারিতে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়েছিল।
সিটওয়ের একজন বাসিন্দা আরএফএকে বলেছেন, জান্তা সেনাবাহিনী আরাকান আর্মির কাছে রাখাইন রাজ্যের একের পর এক অঞ্চল হারিয়ে এখন রাজধানী রক্ষার জন্য রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করছে।
“জান্তা এখন আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সামরিক জান্তা যদি [অঞ্চল হারানো] থামাতে না পারে, তবে রাখাইন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত এবং ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি করে ক্ষমতা দখলে রাখার চেষ্টা করবে।”
বাস্তুচ্যুত ক্যাম্পের ঐ বাসিন্দা বলেন, রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে না চাইলেও তাদের কোনো বিকল্প নেই। রাজ্যের জাতিগত সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা ঠেকাতে তিনি সিনিয়র রোহিঙ্গা নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
আরএফএ রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগের বিষয়ে জিজ্ঞাসার জন্য জান্তার মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুন এবং রাখাইন রাজ্যে জান্তার মুখপাত্র হ্লা থেনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জান্তা রাখাইনের মংডু এবং রাথেডাং শহরে এএ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে।
এখন পর্যন্ত সংঘাতমুক্ত থাকা সিটওয়ে এবং কিয়াউকফিউ শহরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং বিশ্লেষকরা বলছেন যুদ্ধ চলতে থাকলে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা হতে পারে।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের আহ্বান
রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগ এবং রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সংঘাত উসকে দিতে চাইছে সেনাবাহিনী – এমন খবরের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সেখানে দাতা সংস্থাগুলো প্রবেশের অনুমতি এবং পরিস্থিতি মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়ার জন্য যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
বুথিডং শহরে নতুন করে সহিংসতায় “সম্ভাব্য কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিক, প্রধানত রোহিঙ্গা” বাস্তুচ্যুত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক গত সপ্তাহে সব পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ১৯ মে এক বিবৃতিতে তুর্ক বলেন “জাতিগত রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মাঝে সক্রিয় সামরিক প্ররোচনায় একটি সংকটময় সময় তৈরি হয়েছে, যখন আরও নৃশংস অপরাধের ঝুঁকি বিশেষভাবে তীব্র।”
“আমরা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিতবহ তথ্যগুলো নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি। এ অবস্থায় আমি সরাসরি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান সেনাবাহিনীর কাছে যুদ্ধ থামাতে, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে এবং অবিলম্বে নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তার জন্য সেখানে প্রবেশের অনুমতি দিতে আবেদন জানাচ্ছি। আন্তর্জাতিক আইন পুরোপুরি ও নিঃশর্তভাবে মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি,” বলেন তিনি।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা ২৪ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভূ-উপগ্রহের চিত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে এএ আক্রমণের পরে প্রায় পুরো বুথিডং শহরটি জ্বালিয়ে দেয়ায় যখন জান্তা সৈন্য দ্রুত প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তখন কিছু রোহিঙ্গাকে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালাতে দেওয়া হয়নি এবং এএ তাদের হত্যা করেছে।
মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান জেমস রোডেহেভার সম্প্রতি রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে ভুল ও মিথ্যা প্রচারণার তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এএ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম X-এ (সাবেক টুইটার) রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে "মিথ্যা তথ্য" প্রচার করছে।
সামরিক বাহিনীর উসকানি সফল হচ্ছে
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অফ পিস-এর বার্মা প্রোগ্রামের কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসন টাওয়ার আরএফএ-কে বলেছেন, রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা উসকে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে।
“এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বেশ কয়েক মাস ধরে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে আরাকান আর্মি সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে,” তিনি বলেন।
“অনেক রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক নিয়োগ করা হয়েছে এবং … এই মাসে যখন বেশ কিছু সামরিক জান্তা সৈন্য এএ’র কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের মধ্যে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ছিল।”
টাওয়ার বলেন, সেনাবাহিনীর কৌশল হচ্ছে রোহিঙ্গা এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে “আরাকান আর্মির উপর চাপ সৃষ্টি করা।”
“এবং কিছুটা হলেও মনে হচ্ছে এটি সামরিক জান্তার পক্ষে কাজ করছে; যেমন আপনারা এখন দেখতে পাচ্ছেন আরাকান আর্মি এই চাপের কাছে কিছুটা নতি স্বীকার করতে শুরু করেছে,” তিনি বলেন।
রাখাইন রাজ্যের ঘটনাবলি সম্পর্কে এএ যেসব বার্তা দিচ্ছে তা “চরম সমস্যাজনক এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর,” বলেন টাওয়ার।
“এবং এটি আসলে সমস্যাটিকে আরও খারাপ করে তুলছে, যদিও সম্ভবত আরাকান আর্মির এই বার্তার উদ্দেশ্য হলো [রাখাইনের] জনগোষ্ঠীর মাঝে আবেদন তৈরি করা, যারা এতদিন মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে,” তিনি বলেন।
তা সত্ত্বেও এটি কোনোভাবেই বেসামরিক নাগরিক এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার দায়িত্ব থেকে এএ’কে রেহাই দেয় না, টাওয়ার বলেছেন।
“এখানে যা ঘটছে তার জন্য আরাকান আর্মিকে জবাবদিহি করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে চালু থাকা যুদ্ধবিরতি নভেম্বরে অবসান ঘটানোর পর এএ ১৮ মে বুথিডংয়ের সমস্ত সামরিক ক্যাম্প দখল করে নেয়ার ঘোষণা দেয়। তারা এখন রাখাইন রাজ্যের নয়টি শহর এবং সেইসাথে প্রতিবেশী চিন রাজ্যের পালেটওয়া শহর দখল করেছে বলে দাবি করছে।
টাওয়ার বলেছেন, এটি “বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে” যে এএ শেষ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্য থেকে সামরিক বাহিনীকে বিতাড়িত করবে। তবে জাতিগত সেনাবাহিনীর জন্য আসল পরীক্ষাটি হলো তারা বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়গুলোকে পর্যাপ্ত সমর্থন করতে সক্ষম হবে কিনা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অনেক অঞ্চল শাসন করা শুরু করবে কিনা।
বুথিডংয়ের পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য জান্তা এবং এএ-এর সাথে আরএফএ যোগাযোগের চেষ্টা করলেও বুধবার পর্যন্ত উত্তর পায়নি।