মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে রোহিঙ্গা পাচার: পালিয়ে এসেও ভয়ে শরণার্থীরা
2024.11.05
কক্সবাজার ও ঢাকা
“চোখ বেঁধে নিয়ে আমাদের একটি নৌকায় তোলা হয়। নৌকাটি বার্মার কোথায় গিয়ে থেমেছে বুঝিনি; তবে সেখানে একটি সেনাঘাঁটি ছিল,” বেনারকে বলছিলেন বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে মিয়ানমারে পাচার হওয়া ১৬ বছরের এক রোহিঙ্গা কিশোর।
আরো ৮০ জন রোহিঙ্গার সাথে তাঁকে কক্সবাজার থেকে অপহরণ করে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য পাঠানো হয়েছিল।
“তারা আমাদের হাতে অস্ত্র দিয়ে ছবি তুলে সেগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছিল,” উল্লেখ করে সেই কিশোর জানান, তাঁদের তখনো কোনো বুলেট দেওয়া হয়নি। খালি বন্দুক দেওয়া হতো। “অথচ যুদ্ধের সময় আমাদের সামনে রাখা হতো।”
২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে জাতিগত গণহত্যা এড়াতে মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার পর কক্সবাজারে গড়ে ওঠে কুতুপালং-বালুখালী মেগা ক্যাম্প। এখন এই শরণার্থী শিবির থেকেই নানা বয়সী পুরুষদের অপহরণ করে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এমন একাধিক রোহিঙ্গার সাথে কথা বলেছে বেনার, যারা মিয়ানমার গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছেন।
এসব রোহিঙ্গাদের কেউ যুদ্ধ করেছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে আবার কেউ যুদ্ধ করেছেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে। দু’পক্ষই রোহিঙ্গাদের অকেজো অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের সামনে পাঠিয়ে তাঁদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করত বলে জানিয়েছেন শরণার্থীরা।
যুদ্ধফেরত রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগকে শরণার্থী শিবির থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কেউ কেউ গেছেন স্বেচ্ছায়। তবে কেউ কেউ ছিলেন রাখাইনের বাসিন্দা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসায় অপহরণকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদেরকে আবার খুঁজছে বলেও জানান যুদ্ধফেরত রোহিঙ্গারা।
বেনারনিউজের সাথে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেও, নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়েছেন এইসব শরণার্থী।
মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির কাছে পাচার হওয়া ২৫ বছর বয়সী আরেক যুদ্ধফেরত রোহিঙ্গা বেনারকে বলেন, আরাকান আর্মি তাঁদের প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিল, “তোমাদেরকে শুধু সেনাবাহিনী মারতে হবে।”
যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গাদের হাতে অকেজো অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষের সামনে রাখা হতো জানিয়ে ওই যুবক বলেন, “আরাকান আর্মির দেওয়া বন্দুকের গুলি ঠিকভাবে ফোটে না। কিন্তু আমাদের সামনে রাখত। যে কারণে অনেক রোহিঙ্গা মারা গিয়েছে। আমার চোখের সামনে ১০-১২ জনকে মরতে দেখেছি।”
যুদ্ধ থেকে চার মাস পরেই পালানোর চেষ্টার সময় তাঁকে বন্দি করে রাখা হয় বলে জানান ওই যুবক। পরবর্তীতে আরেক সুযোগে তিনি পালিয়ে আসেন।
রোহিঙ্গারা জানান, বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধের সময় সুযোগ বুঝে তাঁরা পালিয়েছেন। পালানোর সুযোগ পেতে তাঁদের কারো এক মাস আবার কারো ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগেছে।
আরাকান আর্মির পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করা ২৫ বছর বয়সী আরেক রোহিঙ্গা তাঁর পালানোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বেনারকে জানান, একবার তাঁদেরকে রাখাইনের “একটি রোহিঙ্গা বসতি পোড়াতে” নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই সময় আরাকান আর্মি তাঁদের হাত থেকে অস্ত্র সরিয়ে নেয় বলেও জানান তিনি।
ওই সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ওই এলাকায় ড্রোন দিয়ে হামলা করলে সুযোগ বুঝে তাঁরা পালিয়ে আসেন।
“রাতে একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা। তারা খাবার দিয়েছিল, আমরা আটজন ছিলাম,” বলেন ওই যুবক।
পরবর্তীতে জনপ্রতি ১২ হাজার টাকা নৌকা ভাড়া দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে আসেন বলে জানান তিনি।
তবে কোনো কোনো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায়ই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করতে গেছেন। কিন্তু যখন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে তাঁদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন তাঁরা পালিয়ে আসেন।
স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যাওয়া ৪২ বছর বয়সী এমন এক রোহিঙ্গা বেনারকে বলেন, “কেউ আমাদের জোর করে নেয়নি, খুশিমনে দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়েছিলাম।”
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের “তোমরা ফিরে আসো, নিজের দেশের দিকে তাকাও। আমাদের সঙ্গে যোগ দাও,” এমন আহ্বান শুনে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি।
তিনি জানান, স্বেচ্ছায় তাঁরা ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মোট ১৫ জন গিয়েছিলেন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীও যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গাদের সামনের সারিতে রাখত জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁদেরকে দেয়া অস্ত্রগুলো ছিল পুরোনো, “পরিত্যক্ত থাকার কারণে অধিকাংশ প্রায় অকেজো।”
তবে কক্সবাজারের আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) অন্যতম সংগঠক, মোহাম্মেদ জুবায়ের বেনারকে বলেন, তাঁর ধারণা অনেক রোহিঙ্গাকে জান্তা বা আরাকান আর্মি “টাকার লোভ দেখিয়েই” যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানান বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বর্তমানে প্রতিমাসে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু ১২'শ টাকা দেয়।
“আমরা হিসেব করে দেখেছি, এক দিনে ৩৩ টাকা পড়ে। তিন বেলা খাবার হলে, একবেলা ১১ টাকা। সেজন্য টাকা-পয়সা নিয়ে কারো পোষায় না।”
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের এটাও অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের পক্ষগুলো অকেজো অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ ছাড়া রোহিঙ্গাদের সামনের সারিতে রাখার প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “এটি এক ধরনের কৌশল। তারা রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের সৈন্য হতাহতের সংখ্যা কমাতে চাইছে।”
পালিয়ে এসেও ভয়
যুদ্ধফেরত শরণার্থীরা জানিয়েছেন, শিবির থেকে তাঁদের অপহরণকারীরা নিজেদের ‘আরএসও’ নামে পরিচিত একটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠনের সদস্য দাবি করে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসায় এখন অপহরণকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের সন্ধান করছে।
“আমরা ক্যাম্পে থাকতে পারি না। লুকিয়ে থাকতে হয় আমাদের। তারা আমাকে এক রাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তখন পিটিয়ে আমার পা ফাটিয়ে ফেলেছে,” বেনারকে বলেন পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা।
অন্য আরেক রোহিঙ্গা বেনারকে বলেন, “এখানে ফিরে এসে একদিন শুধু পরিবারের সাথে থাকতে পেরেছি। তারপরই আমাকে খুঁজতে আসে, মেরে ফেলার জন্য।”
রাখাইনে বসবাসকারী যেসব রোহিঙ্গা গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরাও পালিয়ে বাংলাদেশে আসছেন। পালানোর পর তাঁদেরকেও খোঁজা হচ্ছে বলে বেনারকে জানান আরাকান আর্মির পক্ষে যুদ্ধ করা ২৮ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা।
গত জুনে বাংলাদেশে আসা ওই যুবক বলেন, বাংলাদেশে আসার “দেড়মাস পর শুনি, আমাকে খুব খোঁজা হচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ি গিয়ে বলেছে, আমাকে এনে দিতে হবে।”
“আমার বাবা আরাকান আর্মিকে বলেছেন বলেছেন, বাড়ি এলে তাঁকে আমি তোমাদের হাতে তুলে দেবো,” যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’
রোহিঙ্গারা “বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে” মিয়ানমারে গিয়ে “যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে” আবার বাংলাদেশের ফিরে আসার তথ্য সম্পর্কে অবগত আছেন বলে বেনারকে জানান কুতুপালং শরণার্থী শিবির এলাকায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পুলিশ সুপার মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া।
শরণার্থীদের অপহরণ করে নিয়ে যাবার “সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই,” জানিয়ে তিনি বলেন, এমন অভিযোগ পেলে “আইনানুগ ব্যবস্থা” নেওয়া হবে।”
তবে বাংলাদেশে থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক মিয়ানমারের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাবার সংবাদ “সরকার বা আমাদের দেশের অনেকেই জানেন। গণমাধ্যমে এই খবর বিভিন্ন সময়ে এসেছে,” মন্তব্য করে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এ ব্যাপারে যথেষ্ট তৎপরতা নেই।”
তাঁর মতে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জীবন বিপন্ন হবে বলেই নিজেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন যারা রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের “যেভাবে খোঁজা হচ্ছে, হত্যার চেষ্টা করা হচ্ছে” তা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয় বরং এইসব কার্যক্রম বাংলাদেশের “নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে।”
এ প্রসঙ্গে এপিবিএন কর্মকর্তা জহিরুল কিছুদিন পরপর যৌথ অভিযান চালানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, “যেখানেই আরসা, আরএসও দুষ্কৃতিকারীদের সন্ধান পাই, অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে চালান দেই।”