বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিতে গিয়ে ১৪ রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার

জেসমিন পাপড়ি ও তুষার তুহিন
2017.11.22
ঢাকা ও কক্সবাজার
171122-BD-rohingya-620.jpg শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। নভেম্বর ১৭, ২০১৭।
আবদুর রহমান

মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই। কক্সবাজারের আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত পুলিশ ও পাসপোর্ট কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের দেড় শতাধিক ভুয়া আবেদন চিহ্নিত করেছেন। ওই কার্যালয় থেকে আটক হয়েছে অন্তত নয়জন রোহিঙ্গা, যাদের সাতজনই নারী।

কক্সবাজার ছাড়া্ও দেশের কয়েকটি স্থান থেকে পাসপোর্ট করতে গিয়ে আরও অন্তত পাঁচজন রোহিঙ্গা আটক হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না পায়, সে জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা হিসেবে আপাতত জন্ম সনদ, মৃত্যু সনদ ও জাতীয়তা সনদ দেওয়া স্থগিত রাখা হয়েছে। পাসপোর্টসহ অন্য নাগরিক সুবিধার জন্য এসব সনদের প্রয়োজন হয়।

“জেলার চারটি পৌরসভা ও ৭১ টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের জন্ম ও জাতীয়তা সনদ দিতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় সার্ভার থেকে কক্সবাজার জেলা আলাদা করে রাখা হয়েছে,” বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন।

এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে স্থানীয়রা কিছুটা বিপাকে পড়লেও রোহিঙ্গারা যাতে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে না পারে সে জন্যই এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা বিকল্প ছিল না।

এদিকে রোহিঙ্গারা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় সব পাসপোর্ট অফিসে সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় পাসপোর্ট অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে দুজন রোহিঙ্গা নারী বাংলাদেশি পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক হন।

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাসুদ রেজওয়ান বেনারকে বলেন, “দেশের বিভিন্ন পাসপোর্ট অফিসে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে আমরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই ও জিজ্ঞাসাবাদ করার ফলে তারা ধরা পড়ছে।”

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম মাসুম বেনারকে বলেন, “ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে পাসপোর্ট করতে আসা অন্তত ১০ নারীকে আটক করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে তাদের ভুয়া কাগজপত্র।”

দেশীয় একটি দালাল চক্রের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাসপোর্ট অফিস সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও দালালের যোগসাজশে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা আটক হলেও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে সিন্ডিকেটগুলো।

যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “পাসপোর্ট তৈরির সঙ্গে জড়িত দালালদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।”

তিনি বলেন, “অতীতে কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছে বলে অভিযোগ আছে। তবে এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু হওয়ায় পাসপোর্ট করা অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। প্রশাসন বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করছে। এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত দালালচক্রকেও ধরে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।”

কক্সবাজারে আটক নয় রোহিঙ্গা, মোট ১৪

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পাসপোর্ট করতে গিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে। এ মাসের শুরুতে রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নের উত্তর নাছিরা পাড়া গ্রামের সৈয়দ আকবর ও হাসনা আরার মেয়ে রিজিয়া বেগম (১৯) পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন।

রিজিয়ার কথাবার্তা সন্দেহজনক হওয়ায় তাকে বাবা–মাকে নিয়ে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করতে বলা হয়। গত ১৫ নভেম্বর আবেদনকারী নারীর মা সেজে পাসপোর্ট অফিসে যান সৈয়দ আকবরের স্ত্রী হাসনা আরা (৪০)।

এ সময় তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে নাম-ঠিকানায় অসংগতি ও জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। একপর্যায়ে কথিত মা হাসনা আরা পালিয়ে যায়। গ্রেপ্তার করা হয় আবেদনকারী রিজিয়া বেগমকে। তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ভুয়া চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্রের সঙ্গে নিজেদের ছবি সংযোজন করে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য আবেদন করার দায়ে গত ৮ নভেম্বর দুপুরে দুই তরুণীকে আটক করে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষ। এরা হচ্ছে; ছেনুয়ারা ও তৈয়বা বেগম। সন্দেহজনকভাবে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

গত ১ নভেম্বর ভুয়া জন্ম সনদ নিয়ে পাসপোর্ট করতে গিয়ে কক্সবাজারে আটক হয় আরও দুই রোহিঙ্গা নারী। তাদের এক মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

গত ১২ অক্টোবর কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ার ঠিকানা উল্লেখ করে আবেদন করে রোহিঙ্গা আবদুল হাকিম। ৫ অক্টোবর আবেদন করে সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের ভুয়া বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন। তারা আবেদনের সঙ্গে জাতীয়তা সনদ ও ভোটার আইডি কার্ডের কপি দিয়েছিল।

এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের উত্তর পাড়া বাসিন্দা পরিচয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে আলম আরা নামে এক নারী। পুলিশি ভেরিফিকেশনে সেরোহিঙ্গা হিসেবে ধরা পড়ে।

এ বিষয়ে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আবু নাঈম মাসুম বলেন, “গত কিছুদিনে ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে পাসপোর্ট করতে আসা নয়জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে তাদের ভুয়া কাগজপত্র।”

তিনি বলেন, এ দেশের কিছু লোভী মানুষের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা পাসপোর্টের আবেদন করছে। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ, জনপ্রতিনিধিসহ সকলকে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন সরকারের মাঠ পর্যায়ের এই কর্মকর্তা।

তবে শুধু কক্সবাজার থেকে নয় গত দুই মাসে পাসপোর্ট করতে সিলেট, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও আটক হয়েছে রোহিঙ্গা নারীরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, গত ১২ অক্টোবর বগুড়া থেকে পাসপোর্ট করতে গিয়ে আটক হয় শিশুসহ মা ও মেয়ে। এর আগে সিলেট থেকে আটক হয় আরও দুই নারী। এ ছাড়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুজন গ্রেপ্তার হয়।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। অপরাধপ্রবণ রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তাদের অপরাধের দায় বর্তাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর।

সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, নির্ধারিত স্থানের বাইরে না যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে তারা।

এ পর্যন্ত অন্তত ৭০০ রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করার পরে মানবিক বিবেচনায় নির্ধারিত ক্যাম্পে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান পুলিশ প্রধান। তবে একই ধরনের কাজ বারবার করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।