জাতিসংঘের স্পিডবোটে বাংলাদেশে এসে কাঠের নৌকায় ফিরেছে মিয়ানমার দল
2023.03.22
ঢাকা ও কক্সবাজার
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার স্পিডবোটে চড়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে বিশ্ব গণমাধ্যমে সমালোচনার মুখে পড়া দেশটির প্রতিনিধি দল বুধবার দেশে ফিরেছে। তবে নিজ দেশের পাঠানো ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকায় ফিরতে হয়েছে তাঁদের।
বুধবার সকাল ১০টার দিকে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার অফিসের তত্ত্বাবধানে ১৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল টেকনাফের ট্রানজিট ঘাট থেকে রওনা হয় বলে বেনারকে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার খালিদ হোসেন।
গত ১৫ মার্চ জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তিনটি স্পিড বোটে প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফরে এসেছিল। ওই দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ।
স্পিড বোটটি জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হলেও বিতর্ক এড়াতে বোট থেকে সংস্থার মনোগ্রাম মুছে ফেলা হয়।
গত ১৯ মার্চ এক বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর জানায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্য এখনো অনিরাপদ।
উত্তর রাখাইন রাজ্য অনিরাপদ হওয়ার পরও কেন মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে সহায়তা করল সেই ব্যাখ্যা দিয়ে ইউএনএইচসিআর বিবৃতিতে জানায়, তারা পরিচয় যাচাইয়ের কাজে ‘লজিস্টিক’ সহায়তা করেছে।
স্পিড বোট দেওয়া এবং সংস্থার নাম মুছে ফেলা ‘লজিস্টিক’ সহায়তার অংশ কি না ইউএনএইচসিআর-এর কাছে তা জানতে চেয়ে বুধবার ই-মেইল পাঠিয়েছে বেনার। তবে সংস্থার কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
খালিদ হোসেন বলেন, “সাত দিনে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎ শেষে তাঁরা (প্রতিনিধি দল) মিয়ানমারে ফিরে গেছেন। যে কাজের জন্য এসেছিলেন সেটি সম্পন্ন করেছেন। সেটি তাদের কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে জানিয়েছে প্রতিনিধি দল।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর পর তাদের পদক্ষেপ বিষয়ে বাংলাদেশকে কিছু জানায়নি।
এদিকে এক হাজারের মতো রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন আগামী এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হতে পারে বলে বুধবার মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ মিন তুনের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে জানায় বার্তাসংস্থা এএফপি।
‘আমাদের সন্দেহ আছে’
বাংলাদেশে বসবাস করা বারো লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র হাজারখানেক শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে মিয়ানমার সরকারের বিতর্কিত পাইলট প্রকল্প নিয়ে নানা মহলে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা নুরুল বশর বলেন, “তাদের সফরে আমাদের কী লাভ হলো সেটি সময় বলে দেবে। তবে আমাদের প্রত্যাশা, নিজ দেশে এমনভাবে ফিরতে পারব যাতে আর কোনো দিন শরণার্থী হতে না হয়।”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিনিধি দলটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে ইউএন-এর লজিস্টিক সার্পোট নিয়েছে, বিষয়টি গোপন করা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে।”
আরআরআরসি কার্যালয় জানায়, প্রতিনিধি দলটি সব মিলিয়ে সাত দিনে ১৪৭টি পরিবারের ৫১৩ জনের তথ্য যাচাই করেছে।
মঙ্গলবার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেফজুর রহমান। তিনি বলেন, “প্রতিনিধি দলটি মিয়ানমারে আমাদের গ্রামের নাম, জনপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছিল। এছাড়া আশেপাশের গ্রামের নামসহ আরও বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে। এর বাইরে তাঁরা অন্য কোনো তথ্য জিজ্ঞাসা করেনি।”
“মিয়ানমারে থাকতে কত সন্তান ছিল, বাংলাদেশে আসার পর কতজন ছেলে-মেয়ে জন্ম নিয়েছে তা জানতে চেয়েছে প্রতিনিধি দল,” বলেন টেকনাফের জাদিমুরা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা বজলুল রহমান।
তিনি আরও বলেন, “আমরা আর এখানে (বাংলাদেশে) থাকতে চাই না। আমরা স্থায়ীভাবে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই।”
প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে।
‘ছলচাতুরি ছাড়া আর কিছু না’
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা এবং উদ্বাস্তু ও অভিবাসন বিষয়ক স্বতন্ত্র গবেষক আসিফ মুনীর মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশে আগমন এবং রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানো।”
“আমরা দেখছি, মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত প্রশাসনিক কাজ; তাঁদের গ্রামের নাম যাচাই, পরিবারের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করে যাচ্ছেন। এর আগেও একবার প্রশাসনিক কাজ শেষ করে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু কোনো রোহিঙ্গা সেখানে ফেরত যায়নি,” বলেন তিনি।
আসিফ মুনীর বলেন, “এবারও প্রত্যাবাসনের জন্য প্রকৃত শর্ত নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। প্রকৃত শর্ত যেমন, রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে কোথায় উঠবেন? তাঁদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে নাকি কোনো ক্যাম্পে? সেখানে তাঁদের চলাচলের স্বাধীনতা থাকবে কি না, জীবিকা নির্বাহ করার সুবিধা থাকবে কি না? এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ অথবা মিয়ানমার কোনো পক্ষই কিছু বলছে না।”
“দুই দেশের আলোচনার মধ্যে রাখাইনের পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেখানে পরিস্থিতির আদৌ উন্নতি হয়েছে কি না সেই বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছে না,” যোগ করেন তিনি।
আসিফ মুনীরের ভাষ্য, “রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। এর অর্থ হলো, তাঁরা তাঁদের দেশে ফিরে যেতে চান কিন্তু সেখানে তাদের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই অবস্থায় তাঁরা যাবেন না।”
“যদি রোহিঙ্গারা না যায়, সে ক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাবে যে, তারা রোহিঙ্গাদের নিতে চায় কিন্তু রোহিঙ্গারা যেতে চায় না। এর মাধ্যমে তারা প্রত্যাবাসন না হওয়ার দায় রোহিঙ্গাদের ওপর চাপাবে,” বলেন তিনি।
পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন মূলত একটি ছলচাতুরি ছাড়া আর কিছু নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।