মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
এসময় রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল নিশ্চিতে সম্ভাব্য সব রকম চেষ্টা করার অঙ্গীকার করেন বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গারা যেন আগামী বছর মিয়ানমারের রাখাইনে তাঁদের নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারেন সে লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দেন তিনি।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারি যে, এই সংকট এড়াতে আমরা সবকিছু করব এবং তহবিল পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করতে পারে—এমন সব দেশের সঙ্গে আমি কথা বলে যাব।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কার্যকর সহায়তার আহ্বান জানিয়ে গুতেরেস বলেন, “রোহিঙ্গাদের জরুরি-ভিত্তিতে আরও সহায়তা প্রয়োজন।”
রোহিঙ্গাদের “নিরাপদ, স্বেচ্ছামূলক এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে” মিয়ানমার ফিরে যাওয়াই এই শরণার্থী সংকটের “মূল সমাধান” বলে উল্লেখ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
শুক্রবার সন্ধ্যার ইফতারে অংশ নেওয়ার আগে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে দেখেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা লার্নিং সেন্টার, রোহিঙ্গাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
রোহিঙ্গাদের মতে, সামনের পরিস্থিতি কঠিন হবে
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর নিয়ে উখিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা নূর জাহান বেনারকে বলেন, তাঁরা খাদ্য সহায়তা কমে আসা নিয়ে “ভীষণ উদ্বিগ্ন।”
শরণার্থীরা যখন প্রতিমাসে মাথাপিছু সাড়ে ১২ ডলার সহায়তা পেতেন “তখনও খাবারের অভাব ছিল,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেটা ৬ ডলারে নেমে আসায় সামনের পরিস্থিতি কঠিন হবে। অনেকেই না খেয়ে থাকতে বাধ্য হবে।”
উখিয়া কুতুপালংয়ে আয়োজিত ইফতারে অংশগ্রহণকারী টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াছ (৪২) বলেন, "বিশ্বের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে ইফতার করতে পেরে সৌভাগ্যবান মনে করছি। সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত নিজ দেশে ফেরার আশ্বাস আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আশা করছি, এ সফরের মাধ্যমে আমাদের সংকটের সমাধান হবে।"
কক্সবাজারে আসার আগে জাতিসংঘ মহাসচিব শুক্রবার সকালে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঢাকায় তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডার প্রতি জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন মহাসচিব। এরপর তাঁরা একই বিমানে কক্সবাজার ভ্রমণ করেন। ইফতার শেষে একসাথে ঢাকায় ফেরেন তাঁরা।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ইস্যু ও অগ্রাধিকার বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান।

পদপিষ্ট হয়ে এক শরণার্থীর মৃত্যু
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অংশগ্রহণে লাখো রোহিঙ্গার সাথে আয়োজিত ইফতারের স্থানে প্রবেশ করতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে এক রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরও চার জন।
শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার ২০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেলিপ্যাড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আরিফ হোছাইন।
ওসি জানান, ইফতার মাহফিলে যোগ দিতে গিয়ে পাহাড়ের ঢাল থেকে পড়ে পদপিষ্ট হয়ে তিন জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক শরণার্থী নেয়ামত উল্লাহকে (৫০) মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনায় আহত বাকি দুইজন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
এছাড়া ইফতারের স্থানে প্রবেশ করতে গিয়ে আহত অন্য দুই শরণার্থী প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জানান তিনি।
ইফতারির স্থলে প্রবেশের সময় নিহত রোহিঙ্গার জন্য শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব ও তাঁর সাথে ইফতারে যোগ দেবার জন্য ওই বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ধন্যবাদও জানান তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের আমন্ত্রণে গত বৃহস্পতিবার ৪ দিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশে আসেন আন্তোনিও গুতেরেস। এর আগে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে আন্তোনিও গুতেরেস প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সে সময় তিনি কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরও পরিদর্শন করেন।
সফর শেষে রোববার সকালে ঢাকা ছাড়বেন গুতেরেস।