দাতাদের মনোযোগ ইউক্রেনে, তহবিল কমছে রোহিঙ্গাদের জন্য
2023.09.02
ওয়াশিংটন
ইউক্রেন এবং আফগানিস্তানের চলমান সংকটের দিকে বৈশ্বিক দাতাগোষ্ঠী দৃষ্টি ফেরানোর ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা মারাত্মকভাবে কমে গেছে বলে মনে করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
গত বছর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ত্রাণ তহবিল ছিল বিশ্বের সবার্ধিক সাহায্যপুষ্ট তহবিলের একটি। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর রোহিঙ্গা ত্রাণ তহবিল নেমে আসতে পারে এ যাবতকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিল ব্যবস্থাপনার কাজ করে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান বা জেআরপি। জাতিসংঘের কোর্ডিনেশন অব হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছর জেআরপি’র ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এখন পর্যন্ত সংগ্রহ মাত্র ২৬৮ মিলিয়ন, বা এক তৃতীয়াংশ।
এই সহায়তাহ্রাস হ্রাস এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি চলতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩% কমিয়ে প্রতিমাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে। যদিও তারা স্বীকার করেছে যে ৪৫% শরণার্থী পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না, পাশাপাশি, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরজুড়ে অপুষ্টিতেও ভুগছে মানুষ।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি বেনারকে বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে [রোহিঙ্গাদের জন্য] সাহায্য কমে আসছে, এবং জেআরপি এখনও তহবিল সংকটে ভুগছে। ইউক্রেন, সুদান এবং আফগানিস্তানের পরিস্থিতির জন্য দাতাদের তহবিল সংকুচিত হয়েছে।”
“খাদ্য সহায়তা হ্রাসের ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ প্রভার তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়ক্ষেত্রেই ঘটেছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দাতা দেশগুলোর উচিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করা।”
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জেআরপির বৃহত্তম দাতা দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বছরে দেশটির সহায়তার পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছর ছিল ৩৩৬.৭ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ সালে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিরক্ষা সহায়তার পরিমাণ হচ্ছে ২২ বিলিয়ন ডলার। আগের বছর যা ছিল গড়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
রোহিঙ্গা সংকট এখন আর ‘জরুরি পরিস্থিতি নয়’
বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) কর্মকর্তা রোমেন ডেসক্লাস বলেছেন, জেআরপি বছরের শেষ নাগাদ ক্রমান্বয়ে তহবিল পেতে থাকবে, তবে এটি সম্ভবত আগের পরিমাণের সাথে মিলবে না।
তবে তাঁর মতে, এটি দাতাদের দিক থেকে ‘অবসাদ’ বা ‘অনাগ্রহের’ কারণে নয়। গত বছর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিষয়টি সর্বোচ্চ আর্থিক মানবিক সহায়তার মধ্যে ছিল।
“প্রথমত এটি আর আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি নয়। একে এখন আমরা প্রলম্বিত পরিস্থিতি বলি। তার মানে হলো, মানবিক জরুরি তহবিল এখন অন্যান্য জরুরি অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে এবং বিশ্বে জরুরি অবস্থার অভাব নেই,” যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, প্রধান দাতা দেশগুলোর সামগ্রিক সাহায্য বাজেটও হ্রাস পেয়েছে, যা অন্যান্য অনেক মানবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইউএসএ-এর বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়ার মতে, “বিশ্বকে যখন এখনো কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় লড়াই করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের দিক পরিবর্তন করেছে, কারণ এই সংঘাত বিশ্বব্যাপী সুরক্ষা ব্যবস্থাকে গভীরভাবে পর্যুদস্ত করে তুলেছে। তবুও আমরা আমাদের সম্মিলিত চেতনার শক্তিতে বাঁচি এবং এগিয়ে যাই।”
তিনি বলেন, “এই লাখ লাখ শরণার্থীকে ভুলে যাওয়ার কোনো অজুহাত থাকা উচিত নয়।”
সাহায্য ‘কমানো নয়, ধারাবাহিকতা’ দরকার
চলতি বছর নাটকীয়ভাবে সহায়তা কমার মূল কারণ হলো মারাত্মকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা হ্রাস পাওয়া।
অন্যান্য উৎস থেকে সহায়তা আগেই হ্রাস পেলেও, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থায়ন বৃদ্ধি করেই যাচ্ছিল, যা জাতিসংঘ এবং ত্রাণকারী সংগঠনগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। কিন্তু এই বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে।
গত বছর পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের অন্তত ৪০% ভাগই আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
গত বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ, টাকার অংকে যা ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার। তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের সহায়তার পরিমাণ ছিল এর দশ ভাগের এক ভাগ।
কিন্তু এই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ১০০ মিলিয়নে নেমে আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে শুধু রোহিঙ্গা নয়, বৈশ্বিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ কমেছে।
রোহিঙ্গাদের কাজের অনুমতি দেবার পরামর্শ
ForeignAssistance.gov-এর তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন বৈশ্বিক সহায়তা বিতরণের পরিমাণ গত বছরের ৫৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার থেকে কমে এ বছর ২৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
“চাহিদা রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছালেও গত বছর থেকে মার্কিন মানবিক সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের ওপর মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে,” বলেন রিফ্যুজি ইন্টারন্যাশনালের আঞ্চলিক পরিচালক ড্যানিয়েল সুলিভান।
তিনি বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ২০২১ সালের মার্চে গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে সহায়তা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই পথটি জীবন রক্ষাকারী সাহায্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার মাধ্যমে শুরু করতে হবে, হ্রাস করে নয়।”
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র দেশটির কাছ থেকে সহায়তা কমার কারণ ব্যাখ্যা না করলেও পরামর্শ দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন হ্রাসের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশে শরণার্থীদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া উচিত।
মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, “শরণার্থীদের জীবিকা অর্জনের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিধিনিষেধগুলো পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য দেশটির কর্তৃপক্ষের সাথে দেখা করে আমরা তাদের উৎসাহ দিচ্ছি। এতে আমাদের মানবিক সহায়তাদানকারী অংশীদাররা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের সাহায্যে মনোনিবেশ করতে পারবে।”
পশ্চিমা দাতাদের কাছ থেকে এই অনুরোধ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তবে শরণার্থীদের শিবিরের ভেতরে বা বাইরে কাজ করতে দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অনিচ্ছার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
“পশ্চিমারা আমাদের পরামর্শ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে লাগাতে। এটা সম্ভব নয়,” মন্তব্য করে আব্দুল মোমেন বলেন, “আমরা আমাদের নিজেদের লোকদের কাজ দিতে হিমসিম খাচ্ছি।”
প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আহম্মদ ফয়েজ।