‘আমরা জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাবো না’: বাংলাদেশের কর্মকর্তা

কামরান রেজা চৌধুরী ও আব্দুর রহমান
2018.11.12
ঢাকা ও কক্সবাজার
‘আমরা জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাবো না’: বাংলাদেশের কর্মকর্তা রোহিঙ্গা শরণার্থী নুর আলম বললেন, কক্সবাজারের আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে মিয়ানমারে ফিরতে তিনি প্রস্তুত নন। নভেম্বর ১২, ২০১৮।
ছবি: আবদুর রহমান/ বেনার নিউজ

যতক্ষণ পর্যন্ত না জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) শরণার্থীদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপার নিশ্চিত করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে না বলে বেনারনিউজকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের এক কর্মকর্তা।

এর আগে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন মিয়ানমার সরকার। দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত উ লুইন উ সোমবার রাতে এমনটাই বলেছিলেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমরা নভেম্বর ১৫ তারিখে প্রত্যাবাসন শুরু করতে যাচ্ছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৫ তারিখ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দৈনিক ১৫০ জন করে প্রত্যাবাসী ফিরে যাবে।”

এর আগে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেনের সাথে দেখা করে মিয়ানমার সরকারের নেওয়া প্রস্ততি সম্পর্কে জানান। তাকেও বাংলাদেশের প্রস্ততির কথা অবহিত করা হয়।

মহাপরিচালক দেলোয়ার বেনারকে বলেন, “আমাদের পলিসি হচ্ছে, কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আমরা জোর করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবো না। ফেরত যাবার সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নিজেই নেবে।”

মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রথম তালিকার প্রথম পর্যায়ের ২২৬০ জনের মধ্যে কিছু কিছু শরণার্থীদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়নি। সেকল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে সরাসরি তাদের বাড়িঘরে নিয়ে যাওয়া হবে।

দেলোয়ার জানান, যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে তাদের নতুনভাবে তৈরি করা বাসায় নেয়া হবে বলে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানান হয়েছে।

“বাংলাদেশ কাউকে জোর করে ফেরত পাঠাবে না,” উল্লেখ করে তিনি জানান, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যাবে কিনা তা জানতে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্ত এখন পর্যন্ত তারা এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি।

নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না নিয়ে তারা ফিরতে চায় না বলে বেনারকে জানিয়েছে নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর নেতারা। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, তারা এ মুহুর্তে প্রত্যাবাসন সমর্থন করছে না।

তাদের মতে, রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট ফিরাস খাতিব এক ই-বার্তায় বেনারকে বলেন, “আমাদের অবস্থান পরিষ্কার: আমরা বিশ্বাস করি এ মুহুর্তে তাদের ফিরে যাওয়ার সহায়ক পরিবেশ নেই।”

“আমরা এই অবস্থায়, আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সমর্থন করতে পারি না,” যোগ করেন তিনি।

খাতিব জানান, ইউএনএইচসিআর এর সাথে সম্পাদিত সমঝোতা স্বারক অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যাবে কিনা তা বিষয়টি পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। তারা সেই কাজটি করবে।

“তবে আমরা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না,” বলেন তিনি।

প্রত্যাবাসন এড়াতে পালিয়ে রোহিঙ্গারা

প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম রয়েছে নুর আলমের (৩০)। তার বাড়ি মিয়নমার মংডু বলিবাজার গ্রামে। তিনি গত বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। বর্তমানে টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা শিবিরের বি-ব্লকের ৯৪৩ রুমে বসবাস করছেন।

“গত তিন আগে রোহিঙ্গা বিষয়ক এক কর্মকর্তা ডেকে নিয়ে জানিয়েছেন যে, প্রত্যাবাসন তালিকায় আমার নাম রয়েছে। আমাকে আগামী ১৫ নভেম্বর মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে,” বেনারকে বলেন তিনি।

নূর আরো বলেন, “আমাদের অনেকের মা-বাবা, ভাই-বোনকে হত্যা করা হয়েছে। এর বিচার করতে হবে। আমাদের ঘর-বাড়ি বানিয়ে দিতে হবে না; নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ দাবিগুলো মানলেই আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাবো।”

“এই মূর্হতে সেখানে ফিরে যাবার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এর চেয়ে এপারে আমাদের ‘জবাই’ করা হলেও ভালো। তবুও ওখানে যেতে চাই না,” এমন মন্তব্য করে তিনি জানান, জোর করে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয়ে তিনি ঘরে থাকছে না।

একই ব্লক থেকে আরও নয় পরিবারের নাম রয়েছে প্রত্যাবাসনের তালিকায়। তাদের অবস্থাও একই রকম। মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া এমন লোকজনের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির খবর পেয়েছেন  বলে বেনারকে জানান আরেক রোহিঙ্গা আবুল কালাম (২৮)।

তার বাড়ি ছিল মিয়ানমার মংডু নাকমুড়া পাড়া গ্রামে। বর্তমানে উনচিপ্রাং এ বল্কের ২৩৪ নম্বার রুমের বাসিন্দা। তিনি বলেন, “খবর পাওয়ার তিন দিন পর রোহিঙ্গা বিষয়ক এক কর্মকর্তা আমাদের ঘরে আসে। পরে একটি হলুদ কার্ডে পরিবারের সবার নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে যান।”

পরে তিনি জানতে পারেন, সেটি ছিল এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেসন) কার্ড। এটি দিয়ে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। কালাম বলেন, “নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হলে সব রোহিঙ্গাই দেশে ফিরে যেতে চাইবে।”

মিয়ানমারের নাইসন ঘুনা পাড়ার মোহাম্মদ আমিন বলেন, “আমার ওয়ার্ড থেকে নয় পরিবারের নাম রয়েছে প্রত্যাবাসন তালিকায়। বিষয়টি ক্যাম্প ইনচার্জ জানিয়েছেন। যাদের নাম তালিকা আছে তাদের মধ্যে অনেকে লুকিয়ে রয়েছে।”

তিনিও বলেন, “নাগরিকত্ব দিলে আমরা নিজেরা স্বেচ্ছায় ফিরে যাবো।”

একাধিক রোহিঙ্গা নেতা বেনারকে জানান, প্রত্যাবাসন তালিকায় কক্সবাজারের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাড়ে তিন শতাধিক রোহিঙ্গাদের নাম থাকার কথা তারা শুনেছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।