সংসদ নির্বাচন: নজরদারি বেড়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2018.12.17
ঢাকা ও কক্সবাজার
সংসদ নির্বাচন: নজরদারি বেড়েছে  রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে টেকনাফ নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে র‌্যাবের নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। ডিসেম্বর ১০, ২০১৮।
আবদুর রহমান

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। আগামী ৩০ ডিসেম্বর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

এ কারণে ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম।

তিনি বেনারকে বলেন, “কক্সবাজারের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নির্বাচনে ব্যবহার হতে পারে এমন আশঙ্কায় ক্যাম্পে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে শুধু চিকিৎসা ছাড়া অন্য কোনো কারণে আশ্রয় শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের বের হওয়া নিয়েও কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন।”

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারির পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর প্রতিও নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না বিষয়ক নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

এ বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করার অভিযোগ বেশ পুরোনো। নজরদারি বাড়িয়ে বিরাট এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। তাই যারা তাদের ব্যবহার করতে পারে তাদের সচেতন করা বা তাদের ওপর নজরদারি থাকা উচিত।”

“অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নির্দেশনা থাকতে পারত যে, তারা রোহিঙ্গাদের কোনোভাবে ব্যবহার করবে না,” মনে করেন তিনি।

টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র অাবদুল্লাহ মনির বেনারকে বলেন, এর অাগে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে এসে কয়েকজন রোহিঙ্গা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে অাটক হয়েছিল। তবে সেই সংখ্যা বা হিসাব মনে নেই। তিনি বলেন, এখন বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছে। তাই বাড়তি সতর্কতা নেওয়া উচিত। বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন।

এদিকে নির্বাচন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদেশি অতিথিদের ভ্রমণও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিরাপত্তাজনিত কারণে সরকারের তরফে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “নিরাপত্তাজনিত কারণে ভোট পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদেশিদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।”

কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সাধারণত, স্পর্শকাতর ওই এলাকা ভ্রমণে সরকার বিদেশিদের বাড়তি নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভোটের মাঠে দায়িত্ব পালন করায় বিদেশিদের নিরাপত্তায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা কঠিন “

“তাই ভোটের আনুষ্ঠানিকতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি এবং কূটনীতিকদের মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভ্রমণ পরিকল্পনা না করতে বলা হয়েছে,” বলেন ওই কর্মকর্তা।

এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতাদেরও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মতলব বেনারকে বলেন, “নির্বাচনী প্রচারণাসহ কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডে যাতে কোনো রোহিঙ্গা সম্পৃক্ত না হয় সে বিষয়ে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সকল রোহিঙ্গাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের নিদর্শনা অনুযায়ী আমরা চলছি।”

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, ফলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।”

তবে মোহাম্মদ রশিদ নামে এক রোহিঙ্গা বেনারকে বলেন, “রিকশা চালিয়ে সংসারের অতিরিক্ত খরচ বহন করি। কিন্তু আমাদের চলাফেরা সীমিত করায় গত দুই দিন ধরে ক্যাম্পের বাইরে বের হচ্ছি না। ফলে বেকার থাকতে হচ্ছে।”

কক্সবাজার জেলায় ৪টি আসনে মোট ভোটার সংখ্যা- ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮২ জন। এর মধ্যে মহিলা ভোটার ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৫৮৫ জন এবং পুরুষ ভোটার ৭ লাখ ৯ হাজার ৪৯৭ জন।

মিয়ানমারের সেনাদের অত্যাচার নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সীমান্ত এই জেলায় আশ্রয় নিয়েছে।

ক্যাম্পে টহল

একাদশ সংসদ নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করার যে আশঙ্কার তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে বলে বেনারকে জানান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) প্রতিনিধি ও টেকনাফ নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কর্মকর্তা আবু হানন্ান।

তিনি বলেন, “নির্বাচনে যাতে কোন পক্ষ রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনা রয়েছে। নির্বাচনের কয়েক দিন আগ থেকে কাউকে ক্যাম্প থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।”

সরেজমিনে টেকনাফ ও উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, নিরাপত্তার দায়িত্বে আগে আনসার বাহিনী নিয়োজিত থাকলেও এখন পুলিশ, র‌্যাব এমনকি বিজিবিও টহল দিচ্ছে।

র‌্যাব-৭ টেকনাফ ক্যাম্প ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহাতাব বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশনার ও র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে কেউ যেন ফায়দা নিতে না পারে, সে ব্যাপারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে র‌্যাবের দুইটি দল টিম কাজ করে যাচ্ছে। নির্বাচনে রোহিঙ্গারা যাতে কোনোভাবেই সমস্যা হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে র‌্যাব।”

নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবদুল বর বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যৌথ বাহিনীর তিন দল টহল দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এ টহল বাড়ানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত করে দেওয়া হয়েছে।”

সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হাসান বেনারকে বলেন, “কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত হতে দেওয়া হবে না, সে বিষয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা-বাহিনী মোতায়েন  করা হয়েছে।”

“পাশাপাশি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো গোয়েন্দার নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে নির্বাচনের সময় ক্যাম্প থেকে কোন রোহিঙ্গাদের বের হতে দেওয়া হবে না,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।