ফাহিম সালেহর মৃত্যকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ
2020.07.16
ঢাকা
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তরুণ উদ্যোক্তা ও রাইড শেয়ারিং সেবা ‘পাঠাও’ এর সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ খুন হওয়ার ঘটনাকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। তবে অত্যন্ত মেধাবী এই বাংলাদেশিকে হত্যার বিচার পাওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখছে বাংলাদেশ সরকার।
ফাহিম সালেহ হত্যার ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে এক শোকবার্তায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, “তাঁর মৃত্যুতে আমরা প্রযুক্তি খাতের আন্তর্জাতিক মানের অসাধারণ মেধাশক্তির অধিকারী একজন তরুণ উদ্ভাবককে হারালাম। তাঁর অভাব কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না।”
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ফাহিম সালেহ ১৫ জুলাই নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের নিজের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হন। পুলিশ ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ফাহিমের খণ্ডিত মাথা ও বিচ্ছিন্ন হাত-পা উদ্ধার করে। হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও ফাহিমের হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে পুলিশ হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা থেকে যোগাযোগ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন মাহবুব হাসান সালেহ বেনারকে বলেন, “শুধু বাংলাদেশ নয়, ফাহিম সালেহ এর মতো প্রতিভাবান তরুণের মৃত্যু পুরো বিশ্বের জন্য এক বিরাট ক্ষতি। এতো অল্প বয়সে তিনি যে সফলতা লাভ করেছেন তা অবিশ্বাস্য।”
বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার শামীম আহমেদ বেনারকে বলেন, “ফাহিম যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এ দেশের পুলিশ তাঁর খুনের বিষয়টি তদন্ত করছে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।”
এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস মিনিষ্টার বলেন, “নিজ দেশের নাগরিকের খুনের তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো দেশকে জানাবে না। তবে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, পুলিশ হত্যাকারীকে শনাক্ত করতে পেরেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণেই খুন হয়েছেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা তরুণ।”
যেভাবে খুন হন ফাহিম
পুলিশের বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার না করা গেলেও খুনিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দৈনিকটি জানিয়েছে, সম্পূর্ণ কালো পোশাক, কালো মাস্ক ও গ্লাভস পরা একটি লোক লিফট থেকে ফাহিম সালেহকে অনুসরণ করছিলেন। লিফটের দরজা থেকে বের হওয়ার পরপরই লোকটি ইলেকট্রিকাল শটগানের শক দিয়ে ফাহিমকে নিস্তেজ করে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পরেই ফাহিমকে হত্যা করে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে মাথাসহ বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
তদন্তকারীদের বর্ণনা অনুযায়ী, খুনি ইলেকট্রিক করাত দিয়ে ফাহিমের দেহ টুকরো টুকরো করে। ব্লিচ দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে। এসময় ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজে ওঠে। কেউ একজন ফাহিমের ফ্ল্যাটে এসেছিল। তাই সব কাজ শেষ না করেই সাত তলা অ্যপার্টমেন্টের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় হত্যাকারী। পুলিশর ধারণা, এই এক্সিট প্ল্যান ছিল পূর্ব পরিকল্পিত।
তদন্তকারীদের বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, হত্যার কারণ ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব হতে পারে।
এদিকে এক বিবৃতিতে ফাহিমকে খুনের ঘটনায় হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি সাংবাদিকসহ সকল মহলের প্রতি এ কঠিন সময়ে তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে।
কে এই ফাহিম?
বাংলাদেশি বাবা–মায়ের সন্তান ফাহিমের জন্ম সৌদি আরবে। পরে বাবা-মায়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো ফাহিম বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশে রাইড শেয়ার অ্যাপ পাঠাওয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা।
ব্রিটেনের ডেইলি মেইল ফাহিম সালেহকে একজন মিলিয়নিয়ার প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তা হিসেবে বর্ণনা করেছে। অল্প বয়সেই সারা বিশ্বের নজরে আসা ফাহিম সালেহ এর এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও দৃষ্টি এড়ায়নি।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে এসে প্রযুক্তিভিত্তিক বেশ কিছু ব্যবসার উদ্যোগ নেন ফাহিম সালেহ। বেশ কিছু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও আরো দুজন উদ্যোক্তার সাথে মিলে রাইড শেয়ার অ্যাপ ‘পাঠাও’ তাকে সফলতা এনে দেয়। বছর দুয়েক আগে সহ উদ্যোক্তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে নাইজেরিয়ার লাগোসে গোকাডা নামে একই রকম একটি কোম্পানি খোলেন তিনি। নতুন উদ্যোগ নিয়েও তাঁর বাংলাদেশে আসার পরিকল্পনা ছিল বলে জানা যায়।
বাংলাদেশের জন্য বড় হোঁচট
যোগাযোগ করা হলে পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সিইও হুসাইন এম ইলিয়াস বেনারকে বলেন, “এই মুহুর্তে আমি ফাহিমকে নিয়ে বলার মতো অবস্থায় নেই। তবে আমার অনুভূতির কিছুটা আমি ফেসবুকে লিখেছি, যা সেখান থেকে নিতে পারেন।”
নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেয়া এক বার্তায় বন্ধুর স্মরণে ইলিয়াস লিখেছেন, “পাঠাও দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফাহিম সালেহের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি হতবাক ও ব্যথিত। কারণ বাংলাদেশে প্রযুক্তির সম্ভবনাকে জীবন্ত করায় বিশ্বাসী ছিলেন ফাহিম।”
“আমাদের মধ্যে প্রতিশ্রুতি ছিল; আমরা একই উদ্দেশ্য কাজ করতাম এবং আমাদের উদ্দেশ্য শেয়ার করতাম। পাঠাও এবং আমাদের পুরো ইকোসিস্টেমের জন্য অবিশ্বাস্য অনুপ্রেরণা ছিল ফাহিম। সে আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে,” বলেন ইলিয়াস।
ফাহিম সালেহর অকাল মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম কোনোভাবেই এ মৃত্যু মানতে পারছে না। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়েছেন তাঁরা।
আরেক তরুণ উদ্যোক্তা ও আমরাই বাংলাদেশ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা আরিফ আর হোসেন বুধবার ফাহিমের খুনের খবর জানিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন, “বিশ্বের ময়দানে বাংলাদেশি লিডার গঠনের দৌঁড়ে নিঃসন্দেহে আজকের দিন বাংলাদেশের জন্য একটা বড় হোঁচট। এ রকম দিন আর না আসুক।”
প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক তাঁর শোক বার্তায় বুধবার বলেছেন, “মেধাবী এই উদ্ভাবক বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে রাইড শেয়ারিং অ্যাপস কোম্পানি, ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যার তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যা সমাধান করে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছেন। বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।”