সাঁওতাল পল্লিতে পুলিশ সদস্যরাই আগুন দিয়েছে: বিচারিক প্রতিবেদন
2017.01.31
গাইবান্ধার চিনিকল এলাকা থেকে আদিবাসী সাঁওতালদের উচ্ছেদের জন্য তাদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়েছিল খোদ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
প্রায় দেড় মাস তদন্ত শেষে ৬৫ পৃষ্ঠার বিচারিক প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই তদন্ত পরিচালনা করেন গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. শহিদুল্লাহ।
প্রতিবেদনটি গ্রহণ করে শুনানি শেষে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি আদেশের দিন ধার্য করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু সাংবাদিকদের বলেন, “এক নজরে প্রতিবেদনের মতামত অংশে আমরা যেটি দেখেছি, আগুন লাগানোর ঘটনায় স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এবং দু’জন পুলিশ সদস্য ও একজন গোয়েন্দা পুলিশ সদস্য সম্পৃক্ত ছিলেন।”
তদন্তকারী বিচারকের অভিমত
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ, প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তদন্ত কমিটি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “পোশাক পরিহিত থাকায় সাঁওতালদের স্থাপনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।”
তবে পুলিশ সদস্যরা হেলমেট পরে আগুন দেওয়ায় তাদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনার দিনে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের তালিকা পুলিশ সুপারের কাছে চেয়েও পাওয়া যায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী বিচারক।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এর আগে সাঁওতাল পল্লিতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ঘরবাড়িতে পুলিশের আগুন ধরিয়ে দেওয়ার যে ভিডিও প্রকাশ হয়েছে সেটি সঠিক নয়।
গত বছরের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকল এলাকায় বসবাসরত সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার জন্য অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। ওই ঘটনায় তিন সাঁওতাল নিহত ও অন্তত ২০ জন আহন হন। উচ্ছেদের আগে থেকেই জমির মালিকানা নিয়ে সরকারি চিনিকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ চলছিল সাঁওতালদের।
পুলিশ সাঁওতাল পল্লিতে আগুন দিচ্ছে এমন একটি ভিডিও চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয়। পরে গত ১৪ ডিসেম্বর আগুন দেওয়ার সঙ্গে কারা জড়িত তা তদন্তে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত।
আগুন দিয়েছিল কারা?
যারা আগুন দিয়েছে তাদের কাউকে চেনেন কি না, জানতে চাওয়া হলে ওই সংঘর্ষে আহত সাঁওতাল সদস্য চরণ সরেন বেনারকে বলেন, “যাদেরকে ভিডিওতে আগুন লাগাতে দেখা গেছে তার মধ্যে সাদা শার্ট পরা ব্যক্তি মিলের কর্মকর্তা নাজমুল হুদা। অন্যরা পুলিশের পোশাক ও হেলমেট পরা ছিল।”
এ বিষয়ে সাঁওতাল নেতা দ্বিজেন টুডু বেনারকে বলেছেন, “আগুন যারা দিয়েছিল তারা পুলিশেরই লোক। একটি বাহিনীর সদস্য তার অফিসারের নির্দেশ ছাড়া এই কাজ করতে পারে না। সেদিন কোন অফিসার দায়িত্ব পালন করেছিল তা পুলিশ বাহিনী ভালো করেই জানে।”
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল জাজিরা টেলিভিশনে প্রদর্শিত ভিডিওচিত্র পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, কিছু পুলিশ সদস্য এবং দু’জন সিভিল পোশাকধারী ব্যক্তি সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানোয় সক্রিয় অংশ নেন। আরও কিছু পুলিশ সদস্য কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যারা আগুন লাগাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। তবে তারা আগুন নেভানোর চেষ্টাও করেননি।
এতে আরও বলা হয়, চামগাড়ী বিল এলাকায় নির্মিত স্থাপনা থেকে সাঁওতালরা চলে যাওয়ার পর আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ, র্যাব ও ডিবির পোশাক পরিহিত সদস্য এবং সাধারণ পোশাকধারী দুজন ব্যক্তির উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
ওই গ্রুপটির মধ্য থেকে পুলিশের পোশাকধারী দুজন, ডিবির পোশাকধারী একজন ও সাধারণ পোশাকধারী দুজন (লাল ও সাদা রঙের শার্ট পরিহিত) ব্যক্তিকে সক্রিয়ভাবে চামগাড়ী বিল এলাকায় সাঁওতালদের স্থাপনায় আগুন লাগাতে দেখা গেছে।
অপরদিকে কুয়ামারা, সাহেবগঞ্জ ও হরিণমারী এলাকায় সাঁওতালদের নির্মিত স্থাপনায় কতিপয় স্থানীয় জনতা আগুন লাগিয়েছে।
দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
তবে তদন্ত প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি দরিদ্র সাঁওতালদের পক্ষে বিনা খরচে আইনি সহায়তা দানকারী আইজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। বেনারকে তিনি বলেন, “চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সকল পক্ষ রক্ষা করে গাঁ বাঁচিয়ে রিপোর্ট দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “একজন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ সুপারের কাছে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের তালিকা চাইলে তিনি তা উপেক্ষা করেছেন। এটা বিচার বিভাগকে উপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “দলবদ্ধ অভিযান চালানোর সময় তিনজন পুলিশ আগুন দেওয়ার কাজটি করেছে। এর মানে এই আগুন দেওয়ার সঙ্গে পুলিশ বাহিনী জড়িত। কারণ তিনজন পুলিশ আলাদাভাবে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটা দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস”