সাঁওতাল পল্লি পোড়ানো: গাইবান্ধার সব পুলিশ প্রত্যাহার করতে হাইকোর্টের নির্দেশ

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.02.07
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার জন্য অভিযান চালায় পুলিশ। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার জন্য অভিযান চালায় পুলিশ। নভেম্বর ০৬, ২০১৬।
স্টার মেইল

গাইবান্ধার পুলিশ সুপারকে অবিলম্বে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারিক তদন্ত কমিটিকে সব ধরনের সহায়তা না করায় আদালত এই নির্দেশ দিয়েছে।

একই সঙ্গে গোবিন্দগঞ্জের চামগাড়ি এলাকায় চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনার সময় সেখানে দায়িত্ব পালনরত সব পুলিশ সদস্যকেও অবিলম্বে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের বেঞ্চ মঙ্গলবার এই আদেশ দেয়। গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমের তদন্তে সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকার প্রমাণ আসার পর আদালত এই আদেশ দেয়। আগামী ৯ মার্চ আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি করবে।

আদেশে পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলামকে প্রত্যাহারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে স্বরাষ্ট্রসচিবকে বলা হয়েছে। আর পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের নির্দেশ স্বরাষ্ট্রসচিব, আইজিপি ও রংপুর পুলিশের ডিআইজিকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা টেলিভিশনে সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার যে ভিডিও সম্প্রচারিত হয়েছিল সেই ভিডিও পরীক্ষা করে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তর কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানাতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে চার সপ্তাহের মধ্যে আদালতে ‍প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সাঁওতালদের জান-মাল রক্ষা, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত ১৬ নভেম্বর হাইকোর্টে আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থার পক্ষ থেকে একটি রিট দায়ের করা হয়।

এরপর আগুন দেওয়ায় পুলিশ সম্পৃক্ত বলে গণমাধ্যমে আসা খবর যুক্ত করে সম্পূরক আবেদন করে রিট আবেদনকারীরা। শুনানি শেষে গত ১৪ ডিসেম্বর গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. শহিদুল্লাহকে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কারা জড়িত ও এতে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত কি না, তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেয় আদালত।

আদালতের ওই আদেশের পর গত ২৭ ডিসেম্বর মো. শহিদুল্লাহ সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া গ্রামে যান। তারা ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল, বাঙালি পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন এবং আগুনে পোড়া ঘরের কিছু আলামতও সংগ্রহ করেন। এরপর ২৯ জানুয়ারি তিনি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল দপ্তরে ৬৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়-সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনার জন্য কিছু স্থানীয় ব্যক্তি এবং ঘটনার সময়ে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য দায়ী। আগুন লাগানোর সঙ্গে পুলিশের দুজন সদস্য ও একজন গোয়েন্দা (ডিবি) সদস্য সক্রিয়ভাবে জড়িত। ওই সময় আরও কিছু পুলিশ সদস্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা আগুন লাগানোয় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও তা নেভানোর চেষ্টা করেননি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যারা আগুন দিচ্ছিল তাদের মাথায় হেলমেট ছিল। তা ছাড়া অনেক দূর থেকে ঘটনাটি ভিডিও করায় ওই পুলিশ সদস্যদের চেহারা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ সুপারের কাছে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সদস্যদের তালিকা চাইলেও তিনি দেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। বেনারকে তিনি বলেন, আগুন দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনে যেসব পুলিশ সদস্য আগুন দিয়েছেন তাদের চিহ্নিত করতে না পারায় আদালত অসন্তুষ্ট হয়ছেন।

তিনি বলেন, আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা থাকতে হবে। কয়েকজন পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো পুলিশ প্রশাসন কলঙ্কিত হতে পারে না। যেহেতু আগুন লাগানোর বিষয়টা আদালতে এসেছে তাই দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আদালতের দায়িত্ব।

রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন। বেনারকে তিনি বলেন, ঘটনার দিন যারা দায়িত্বে ছিলেন, তদন্ত কমিটি চাওয়া সত্ত্বেও পুলিশ সুপার সেই তালিকা দেননি। মুখ্য বিচারিক হাকিমকে সহযোগিতা না করা হাই কোর্টের আদেশের লঙ্ঘন। এসব কারণে পুলিশ সুপারসহ বাকি পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

জানতে চাইলে রিট আবেদনকারী সংগঠনগুলোর একটি আইন ও সালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার ঘটনাটি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব তথ্য উঠে এসেছিল সেগুলোতে পুলিশের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। আদালতের এই নির্দেশনার পর জড়িত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করলে ঘটনার তদন্ত আরও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।”

ওই মানবাধিকার কর্মীর মতে, তারা উপস্থিত থাকলে ঘটনার আলামত নষ্ট এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার মতো ঘটনা ঘটতে পারত।

গত বছরের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকল এলাকায় বসবাসরত সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার জন্য অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় বিপুলসংখ্যক মানুষ এই অভিযানে অংশ নেয়।

সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল। আহত হন অন্তত ২০ জন। উচ্ছেদের আগে থেকেই জমির মালিকানা নিয়ে সরকারি চিনিকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ চলছিল সাঁওতালদের।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।