পুনর্বাসনের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিলেন সাঁওতালরা

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.05.17
ঢাকা
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ফার্মে সাঁওতালদের পুনর্বাসনের দাবিতে বগুড়ায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ র‌্যালি। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ফার্মে সাঁওতালদের পুনর্বাসনের দাবিতে বগুড়ায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ র‌্যালি। মে ১৭, ২০১৭।
সৌজন্যে আর এইচ রফিক

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল সম্প্রদায় আগামী ৩০ জুন তাদের পৈতৃক ভিটে মাটি দখল করার ঘোষণা দিয়েছে। বুধবার বগুড়া শহরের সাতমাথা চত্বরে আয়োজিত এক মানব বন্ধন ও সমাবেশে ‘সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির’ নেতৃবৃন্দ এই ঘোষণা দেন।

গত বছর নভেম্বর মাসে থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর এটিই তাদের সর্ববৃহৎ প্রতিবাদ সমাবেশ। এতে প্রায় পাঁচ শ সাঁওতালসহ কয়েকজন বাঙালি অংশ নেন।

“আমরা আমাদের সমাবেশ থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, তারা যেন সাঁওতালদের বাপ-দাদার জমি ফিরিয়ে দিয়ে অচিরেই তাদের সেখানে পুনর্বাসিত করে। অন্যথায় আমরা আগামী ৩০ জুন সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার করতে বাধ্য হব,” কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী প্রধান টেলিফোনে বেনারনিউজকে বলেন।

তিনি বলেন, “স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পোষা গুন্ডা বাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গত বছর নভেম্বরে নিরীহ সাঁওতালদের ওপর আক্রমণ করে তাদের পৈতৃক ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে। তারা তিনজন সাঁওতালকে হত্যা করেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুটতরাজ করেছে। মামলা করা হয়েছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। কারণ, আসামিরা প্রভাবশালী।”

“উল্টো, মামলার বাদী ও সাঁওতাল পরিবারদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমরা সকল আদিবাসী পরিবারের পুনর্বাসনসহ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি,” বেনারকে বলেন মামলার বাদী থমাস হেমব্রম।

গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বুধবার বেনারনিউজকে বলেন, “তারাই তো ভয় দেখাচ্ছে। তারা সব সময় তির-ধনুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের ভয়ে আমরা সবাই তটস্থ থাকি।”

সরকারি মালিকানাধীন রংপুর সুগারমিল কর্তৃপক্ষ গত বছর ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকা থেকে কয়েকশ সাঁওতাল পরিবারকে উচ্ছেদ করে।

মিল কর্তৃপক্ষ বলছে, সাঁওতালরা অবৈধভাবে সুগারমিলের জমি দখল করে রেখেছিল। সুগারমিল আখ চাষের প্রয়োজনে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিয়েছে।

অন্যদিকে, সাঁওতাল নেতৃবৃন্দ বলছেন, মিল কর্তৃপক্ষ তাদের বাপ-দাদার ভিটে-মাটি থেকে অন্যায়ভাবে তাদের উচ্ছেদ করেছে।

গত নভেম্বর উচ্ছেদের সময় পুলিশ সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগাচ্ছে—এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। হাইকোর্ট গত বছর ১৪ ডিসেম্বর গাইবান্ধার প্রধান বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র হাইকোর্টে এ বিষয়ে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে।

তা ছাড়া, সাঁওতাল নেতা থমাস হেমব্রম তখন স্থানীয় সংসদ-সদস্যসহ কয়েকজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন।

হাইকোর্টের নির্দেশনার পর গাইবান্ধার প্রধান বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট এম. শহীদুল্লাহ্ জানুয়ারি ৩০ তারিখে তার প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন যে, কিছু পুলিশ সদস্য এবং দুজন বেসামরিক ব্যক্তি সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।

গাইবান্ধা জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন মিয়া বুধবার বেনারনিউজকে বলেন, ওই ঘটনায় বেশ কিছু কিছু সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে ।

“গতকাল আমি এই মামলার তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়েছি। মামলার অগ্রগতি বলতে গেলে আমার আরও কয়েক দিন সময় লাগবে,” তিনি বলেন।

“স্থানীয় প্রভাবশালীরা সাঁওতালদের জমি দখলের জন্য সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে দিয়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য জমিটি দখল করা,” রাজশাহী ভিত্তিক সেন্টার ফর এথনিক স্টাডিজের প্রধান সন্তোষ হেমব্রম বেনারকে বলেন।

তিনি বলেন, সাঁওতালরা ষাটের দশক থেকে ওই অঞ্চলে বসবাস করছে। সুতরাং, এই জমির মালিকানা নিয়ে সুগার মিলের দাবি সঠিক নয়।

“সুগারমিল কর্তৃপক্ষ বলছে যে, আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জের জমি প্রয়োজন। সাঁওতাল নেতৃবৃন্দ সহযোগিতা করলে, এই সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি,” বেনারকে বলেন গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল।

এর আগে ১৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জের গৃহহীন সাঁওতালদের আশ্রায়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘরবাড়ি করে দেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তবে “কোথায় এসব বাড়িঘর তৈরি করে দেওয়া হবে, তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে দেওয়া নির্দেশে বলা আছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ শিগগির সেই ঘোষণা দেবে,” জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

“আমি বগুড়ায় সাঁওতালদের মানববন্ধন ও র‌্যালি সম্পর্কে জেনেছি। আমি এটুকু বলতে পারি যে সরকার তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে আন্তরিক,” বলেন গৌতম চন্দ্র পাল।

তিনি বলেন, “আমরা দেখছি কীভাবে বিকল্প একটি স্থানে তাদের পুনর্বাসিত করা যায়।”

প্রসঙ্গত, সরকার ১৯৫৪ সালে সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। তখনই এ সব জমির মালিকদের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল, চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ ছাড়া ওই জমিতে অন্য কোনো ফসল চাষের জন্য ইজারা দিতে পারবে না। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গ করার অভিযোগ তুলে পূর্বপুরুষের জমির দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামেন সাঁওতালরা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ওই জমিতে গত বছরের জুলাইতে কয়েকশ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন।

পরবর্তীতে গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিন সাঁওতাল এবং আহত হন অনেকে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।