সাঁওতালদের বাড়ি করে দেবে সরকার, ত্রাণ নিলেন তাঁরা
2016.11.16
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে গৃহহীন সাঁওতালদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘরবাড়ি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন, “কোথায় এসব বাড়িঘর তৈরি করে দেওয়া হবে, তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে দেওয়া নির্দেশে বলা আছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ শিগগির সেই ঘোষণা দেবে,” জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে গত সোমবার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ ফিরিয়ে দিলেও বুধবার মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতালরা সরকারি ত্রাণ নিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে দুপুরে ওই দুই গ্রামের ১৫০ পরিবারের প্রত্যেককে ২০ কেজি চাল, এক লিটার তেল, আধা কেজি ডাল, এক কেজি আলু, এক কেজি লবণ ও দুইটি করে কম্বল দেওয়া হয়। সংঘর্ষের পর এসব পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে।
একাধিক সাঁওতাল নেতা জানান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুরোধে তাঁরা এই ত্রাণ নেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নির্দেশে গুলি হওয়ায় তাঁর হাত দিয়ে ত্রাণ নেওয়ার বিষয়ে তাঁদের আপত্তি ছিল।
পরে সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসককে ত্রাণ বিতরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। বুধবার জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ত্রাণবাহী গাড়ি সেখানে পৌঁছে।
আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বেনারকে জানান, “ওবায়দুল কাদের আমাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক একটা সমাধান করা হবে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা বলেছি, পুলিশের করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকেও মামলা নিতে হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ওবায়দুল কাদের তাঁদের বলেছেন, মামলা করতে বাধা নেই। শিগগির আমরাও মামলা করব।”
গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশের ভাষ্য, তারা সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায়। এতে নিহত হন তিন সাঁওতাল এবং আহত হন অনেকে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘর লুটপাট হয়। লুট হওয়া পাট ও কলাইতে সাঁওতালদের ক্ষতির পরিমাণ দুই কোটি টাকারও বেশি।
নিরাপত্তা চেয়ে রিট আবেদন
গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জানমাল রক্ষা, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ এবং স্বাধীনভাবে চলা-ফেরার সুযোগ দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে বুধবার হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছে । সাঁওতালদের উচ্ছেদের সময় কোন কর্তৃত্ববলে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে—তা জানতে রুল চাওয়া হয়েছে এই রিট আবেদনে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থার পক্ষে বুধবার হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট আবেদন করা হয়।
আবেদনকারীদের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বেনারকে বলেন, “রিটে সাঁওতালদের জানমাল রক্ষায় নির্দেশনা চাওয়ার পাশাপাশি তাদের ওপর হামলা, প্রাণহানি ও উচ্ছেদ কার্যক্রম কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না—এ মর্মে রুল জারির আবেদন জানানো হয়েছে।”
স্বরাষ্ট্রসচিব, জন প্রশাসন সচিব, শিল্প সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ মহাপরির্শক, গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান, রংপুর সুগার মিল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কয়েকজনকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
এর আগে চিকিৎসাধীন তিন সাঁওতালের হাতকড়া খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। গত সোমবার বিকেল পর্যন্ত চারজন সাঁওতালকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, যাঁদের তিনজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন হাতকড়া পরা অবস্থায়। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তাঁদের হাতকড়া খুলে দিতে বলেন। এরপর হাতকড়া খুলে তাঁদের জেলে পাঠানো হয়।
ত্রাণ নিলেন সাঁওতালেরা
গাইবান্ধায় নির্যাতনের শিকার সাঁওতালেরা সরকারি ত্রাণ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, তাঁরা আগে পৈতৃক জমি ফেরত চান। গতকাল মাদারপুর ও জয়পুর গ্রামের সাঁওতালরা সরকারি ত্রাণ নিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তাঁদের এই ত্রাণ দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আহম্মদ আলী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা-তুজ-জোহরা ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জহিরুল হক।
প্রশাসনের ত্রাণ নেওয়া প্রসঙ্গে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাস্কে বেনারকে বলেন, “সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সরকার সাঁওতালদের পুনর্বাসন ও অন্যান্য দাবিগুলো পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। তাই আমরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ত্রাণ নিয়েছি।”
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর গুলিবর্ষণের ওই ঘটনায় সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। গতকাল বুধবার সকাল ১১টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত গাইবান্ধা শহরের আসাদুজ্জামান মার্কেটের সামনে মানববন্ধন করে বাংলাদেশ খেতমজুর সমিতি গাইবান্ধা জেলা শাখা।
রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য ১৯৬২ সালে সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গ করার অভিযোগ তুলে পূর্বপুরুষের জমির দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামেন সাঁওতালরা।
এরপর সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ওই জমি সাঁওতালদের ছিল না। ‘ভূমিদস্যুরা’ সাঁওতালদের ‘ব্যবহার করেছে’।
অন্যদিকে সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দারা বলছেন, তারা ‘বাপ-দাদার জমিতে’ থাকার অধিকার চান। উচ্ছেদ হওয়া দেড় শতাধিক পরিবার গত দশ দিন ধরে মাদারপুর চার্চের খোলা প্রাঙ্গণ ও চার্চের পরিত্যক্ত স্কুলভবনে বসবাস করছে।